জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অপ্রকাশিত হলফনামা- অপ্রকাশিত ইতিহাসের একটি সংক্ষিপ্ত ময়নাতদন্ত

পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান যেকোনো ইতিহাসেই একজন ধিকৃত চরিত্র। ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর সব হারিয়ে তিনি জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ইতিহাস থেকে চিরতরে হারিয়ে যান। তার শেষ জীবন ছিল অশেষ কষ্টের। ১৯৭৭ সালে জেনারেল জিয়াউল হক ক্ষমতা দখল করে অসুস্থ ইয়াহিয়াকে মুক্তি দেন। জেনারেল ইয়াহিয়া শেষ জীবনে কপর্দকশূন্য অবস্থায় লাহোরে ছোট ভাইয়ের বাড়ীতে আশ্রিত অবস্থায় দিন কাটান। এসময় তিনি ছিলেন পক্ষাঘাতগ্রস্থ। মৃত্যুর আগে দীর্ঘদিন তিনি বিছানায় জীবন্মৃত অবস্থায় থাকেন। এসময় তিনি কোন কথা বলতে পারতেন না, কোন অঙ্গ সঞ্চালনা ও কাউকে চিনতেও পারতেন না। কেবল শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতেন। ১৯৮০ সালের ১০ আগস্ট ইয়াহিয়া খান মারা যান।

১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়ার অব্যবহিত পূর্বে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যার জন্য ভুট্টো দায়ী। এরপর তার নিজ পৌরোহিত্যে সংঘটিত পাকিস্তানের পতনের ব্যাপারে তার আর কোন বক্তব্য শোনা যায়নি। তবে গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি পাবার পর ১৯৭৮ সালে স্বীয় আইনজীবী মনজুর আহমদ রানার মাধ্যমে লাহোর হাইকোর্টে তিনি একটি হলফনামা দাখিল করেন, যাতে ১৯৭১ সালে সংঘটিত বিভিন্ন গোপন ঘটনার উল্লেখ করা ছিল। ইংরেজিতে টাইপ করা ৫৭ পাতার এই হলফনামা ২০০৫ সালের ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত গোপন রাখা হয়। হলফনামাটি ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারীতে বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নাল অনুবাদসহ প্রকাশ করে।

আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, পুরো হলফনামায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি ইয়াহিয়া খানের খুব একটা উষ্মা প্রকাশ পায়নি! উল্টো ইয়াহিয়া একেবারে স্পষ্ট ভাষায় শেখ মুজিবকে ভুট্টোর চেয়ে অনেক বেশি দেশপ্রেমিক ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ বলে উল্লেখ করেছেন! অন্যদিকে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে তিনি ‘অমসৃণ ত্বক বিশিষ্ট বিষধর ব্যাঙ ধাঁচের প্রাণী’ নামে আখ্যায়িত করেছেন। পুরো হলফনামাতেই নিদর্শন আছে জুলফিকার আলী ভুট্টো কিভাবে ইয়াহিয়া খান, সামরিক বাহিনী ও পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষকে নিজের অঙ্গুলি হেলনে নাচিয়েছেন। সাথে সাথে উন্মেষ হয় ৭১ সালের মূল কসাইয়ের এক ভয়াবহ খল রূপ।

বস্তুত, জেনারেল ইয়াহিয়া খান, জেনারেল টিক্কা খান বা অন্যান্য সকল পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীর পেছনে মূল ইন্ধনদাতা ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। এই কুটিল সিন্ধী ব্যারিস্টার নিজের ক্ষমতার জন্য সজ্ঞানে পাকিস্তানের বিভক্তি হতে দিয়েছেন। তবে পাকিস্তানের অনেকেই যে বিষয়টা আঁচ করতে পারেনি, এমন নয়। আমি ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি, ক্ষমতা দখলের পর জেনারেল জিয়াউল হক হয়তো ভুট্টোকে প্রাণে নাও মারতেন, কিন্তু ভুট্টোর মৃত্যুদণ্ডের মূল কারণ হচ্ছে ১৯৭১ সালের তার ভূমিকা, যা অন্তত জিয়াউল হক বুঝেছিলেন।

হলফনামায় ইয়াহিয়া খান যেসব বিষয়ে আলোকপাত করেছেন, তার সংক্ষিপ্তসার হচ্ছে-

* ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে লিখেছেন, “মুজিব নন, ভুট্টোই পাকিস্তান ভেঙ্গেছেন। ৭১ সালে ভুট্টো যেসব কথা বলেছেন, যে ধরণের গোঁয়ার্তুমি দেখিয়েছেন- পাকিস্তানের সংহতি বিনাশে তা ছিল ছয় দফার তুলনায় অনেক বেশি বিধ্বংসী।”

* ভুট্টো ৭১ সালের মার্চে ঢাকায় আহূত নবগঠিত জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের উদ্বোধনী অধিবেশনে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানালেও এই পরিকল্পনা নাকি ১৯৭০ সালের শেষ দিকেই করা হয়েছিলো। জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত করলে বাঙ্গালীর সহিংস প্রতিক্রিয়াকে ইয়াহিয়া খান ক্ষুব্ধ বাঙ্গালীর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া বলে অভিহিত করেছেন।

* ইয়াহিয়ার মতে বাঙ্গালী খুবই স্পর্শকাতর জাতি, যারা ভালবাসা ও ঘৃণা উভয় ক্ষেত্রেই কোন পরিমাপ করেনা।

* অপারেশন সার্চ লাইট ইয়াহিয়ার একক অনুমোদনেই হয়েছিলো, এবং ভুট্টো এতে খুবই খুশি হয়েছিলেন ও আনুষঙ্গিক পরামর্শও দিয়েছেন। তবে শেখ মুজিবকে জীবিত কিংবা মৃত ধরে আনার আদেশ দিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর ও পূর্বাঞ্চলীয় কম্যান্ডের সর্বাধিনায়ক জেনারেল টিক্কা খান।

* শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবীনামায় প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজনে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু ছয় দফা নিয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বে মতপার্থক্য ছিল। ডঃ কামাল হোসেন, তাজউদ্দীন আহমদ ও খন্দকার মুশতাক আহমদ ভিন্ন মত নিয়ে প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করেছিলেন।

* ইয়াহিয়ার দাবী, তিনি ছয় দফা নিয়েই পাকিস্তানের সংকট নিরসনে আগ্রহী ছিলেন। এমনকি তিনি ছয় দফার উপর নাকি গণভোট নেয়ারও পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিব এতে আগ্রহী ছিলেন না। তাঁর ধারণা ছিলো ছয় দফা গণভোটে প্রত্যাশিত সমর্থন লাভ করতে পারবে না।

* পাকিস্তান ভেঙ্গেছে ভুট্টোর ক্ষমতা লিপ্সার জন্য। আর এই কাজে তাকে সাহায্য করেছিলেন পাকিস্তানের সেনা ও বিমানবাহিনীর কিছু শীর্ষ কর্মকর্তা। এদের মধ্যে প্রধান ছিলেন সেনাবাহিনীর চীফ অভ জেনারেল স্টাফ জেনারেল গুল হাসান খান ও বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল আবদুর রহিম খান। এছাড়াও প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল সৈয়দ গোলাম মোহাম্মদ পীরজাদা সামরিক বাহিনী ও ভুট্টোর আঁতাতের সমন্বয়ক ছিলেন। রহিম খান যুদ্ধের সময় বিমানবাহিনীকে কার্যত নিষ্ক্রিয় করে রাখেন। ভুট্টোর আদেশেই তিনি নিষ্ক্রিয় থাকেন। তিনি প্রেসিডেন্টকে বলেন, জঙ্গিবিমানের খুচরা যন্ত্রাংশ নেই, জ্বালানী তেলও নেই।

* উভয় রণাঙ্গনে যেন পাকিস্তানের হার অবধারিত হয়, সেটা নিশ্চিত করা হয় খোদ পাকিস্তানী জেনারেলদের দ্বারাই।

* ১৯৭১ সালের শুরু থেকেই পাকিস্তানের সকল গোয়েন্দা সংস্থা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। মূলত নির্বাচনোত্তর ভবিষ্যৎ প্রশাসন সম্পর্কিত অনিশ্চয়তার কারণেই তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। কেবল মিলিটারি ইন্টিলিজেন্সই সক্রিয় ছিল। অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার নিষ্ক্রিয়তার কারণে তাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে সকল রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা তৎপরতা চালাতে হয়, যা পাকিস্তানের সামগ্রিক পতনের জন্য বহুলাংশে দায়ী।

* ইয়াহিয়ার কাছ থেকে ক্ষমতা নেয়ার পর সামরিক বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ে প্রায় সবাইকে বরখাস্ত করলেও বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল রহিম খান স্বপদে বহাল থাকেন, গুল হাসান খান নতুন প্রধান সেনাপতি হন। অবশ্য কিছুদিন পরই ভুট্টো নিজ বাড়ীতে নৈশভোজের নামে তাদের ডেকে নিয়ে পিপিপির সশস্ত্র ক্যাডারদের হাতে তাদের বন্দী করিয়ে রেডিও ভাষণ দিয়ে তাদের পদচ্যুত করার ঘোষণা দেন।

* যুদ্ধের শেষে মার্কিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় কম্যান্ডের সপ্তম নৌবহরের আগমন ও উত্তর দিক থেকে চীনের আক্রমণের ব্যাপারটা পুরাই ধাপ্পাবাজী ছিল।

* পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার পরও হঠাৎ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কতৃক পশ্চিম রণাঙ্গনেও একতরফা যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয়া ভুট্টো-ইন্দিরা গোপন আঁতাতেরই ফল।

* সেপ্টেম্বরের শেষেই শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে অত্যন্ত নমনীয় এক কনফেডারেশনের মাধ্যমে পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে নামমাত্র ও আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক রেখে পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান। কিন্তু ভুট্টো ও জেনারেলরা নিত্যনতুন ইস্যু হাজির করিয়ে ইয়াহিয়াকে ছাগল বানান, ফলে তিনি পথভ্রষ্ট হয়ে বেদিশা হয়ে পড়েন। ভুট্টো আর জেনারেলরা পাকিস্তানের চূড়ান্ত পরাজয়ই চাইছিলেন, যাতে ভবিষ্যতে একে পুঁজি করে তারা সংঘবদ্ধভাবে দীর্ঘদিন ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে পারেন।

আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এক্ষেত্রে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হলফনামার বক্তব্যের সাথে লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী, মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর বইয়ের বক্তব্য কার্যত একই। প্রত্যেকেই শেখ মুজিবুর রহমানের চেয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে অনেক বেশি খল হিসেবে প্রতিপন্ন করেছেন, এবং মূল নাটের গুরু হিসেবে অভিহিত করেছেন…।

2 thoughts on “জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অপ্রকাশিত হলফনামা- অপ্রকাশিত ইতিহাসের একটি সংক্ষিপ্ত ময়নাতদন্ত

  1. আপনার এই লেখার জন্য ধন্যবাদ জানাই। আপনি বলেছেন মূল হলফ নামাটি প্রকাশিত হয়েছে। সেটি যদি এখানে সংযোজন করেন তাহলে উপকৃত হতাম। ধন্যবাদ

Leave a comment