বিষয় ও বিবেচনা- মহাথির মোহাম্মদের পাকিস্তান সফর কি ভিন্ন তাৎপর্যবাহী?

গতকাল তিন দিনের এক রাষ্ট্রীয় সফরে পাকিস্তান গেছেন বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ নির্বাহী শাসক মহাথির মোহাম্মদ। রাওয়ালপিন্ডির চাকলালা বিমানঘাঁটিতে সফররত মালয়েশীয় প্রধানমন্ত্রীকে প্রটোকল প্রদান করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। এই সফরের ঘোষিত উদ্দেশ্য হচ্ছে, আগামীকাল পাকিস্তানের জাতীয় দিবসের কুচকাওয়াজে বিশেষ অতিথি হিসেবে মহাথির মোহাম্মদের যোগদান।

নিঃসন্দেহে এটা একটা মনোরম কূটনৈতিক প্রদর্শনীও বটে। কিন্তু এই সফরটি স্রেফ কূটনৈতিক শিষ্টাচার পালনের জন্য হচ্ছে? কেমন পরিস্থিতিতে মালয়েশিয়ায় ৯২ বছর বয়সে মহাথিরকে প্রধানমন্ত্রী হতে হলো, এবং তাঁর বিদেশনীতি কি; সেই বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত এক্ষেত্রে সকলের মনে ভাবনার রশ্মি জ্বালতে পারে।

পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজ্জাকের উন্নয়নমুখী, অথচ দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনের শেষে বিপুল সংখ্যাধিক্যে বলশালী হয়ে মহাথির মোহাম্মদ শেষ বয়সে পুনরায় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হন। নাজিব রাজ্জাকের আমলে যেসকল উন্নয়ন প্রকল্প গৃহীত হয়, তার প্রায় সবগুলোই চীনের অর্থানুকূল্যে সাধিত হয়েছিলো। এসব প্রকল্পের অস্বচ্ছতাকে সামনে রেখে মহাথির মোহাম্মদ ক্ষমতাসীন হন। দায়িত্ব নিয়ে তিনি এমন বেশ কিছু প্রকল্প বাতিল করেন।

শুধু তাই নয়, মহা গুরুত্বপূর্ণ মালাক্কা প্রণালী ঘিরে চলমান ভূরাজনীতির স্পর্শকাতর খেলায় মহাথিরের নেতৃত্বে মালয়েশিয়ার অবস্থান চীনের জন্য স্পষ্ট অস্বস্তিজনক এক পরিস্থিতির জন্ম দেয়। নির্বাচিত হবার পরদিনই তিনি মালাক্কা প্রণালীকে নিরপেক্ষ রাখার পক্ষে মত দেন। এটা আমেরিকার চেয়েও বেশি চীনের ভ্রুকুঞ্চনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মহাথির মোহাম্মদ স্পষ্টভাবেই সেই সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন যে, মালাক্কা প্রণালীতে তিনি কোন রণতরী দেখতে চান না। কারণ একটি দেশের রণতরী অন্য দেশের রণতরীদের আকৃষ্ট করে।

এজন্য চীনের জন্য মহাথির মোহাম্মদের সাথে সম্পর্ক পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়া জরুরী হয়ে পড়ে। পরাশক্তিদের ক্ষেত্রে অনেক সময় এমন কোন তৃতীয় দেশ এই প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, যার সাথে উভয় দেশেরই সমান সুসম্পর্ক রয়েছে। পাকিস্তানের সাথে বেইজিং ও পুত্রযায়া, উভয়েরই গভীর সম্পর্ক রয়েছে।

তাছাড়া পাকিস্তান অতীতে আরো বড় বড় দেশের মধ্যে আরো জটিল প্রেক্ষাপটে সম্পর্কোন্নয়নের দূতিয়ালি করেছিলো। এটা অনেকের নিকট অবাক করা হলেও সত্যি হচ্ছে, খোদ চীন ও আমেরিকার সম্পর্কই পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় গড়ে উঠেছিলো।

১৯৪৯ সালে জেনারালিসিমো চিয়াং কাই শেকের জাতীয়তাবাদী সরকারকে পরাজিত করে মাও সে তুং চীনে কমিউনিস্ট হুকুমত কায়েম করে ঘোষণা করেন গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের। অপরদিকে জেনারালিসিমো তাঁর লটবহর নিয়ে তাইওয়ানে পলায়ন করেন। সেখানে তিনি চীনা প্রজাতন্ত্র তথা রিপাবলিক অভ চায়না নামে সরকার গঠন করেন। আজো তাইওয়ানের সরকারী নাম রিপাবলিক অভ চায়না।

পশ্চিমারা তাইওয়ানে স্থাপিত চিয়াং কাই শেকের সরকারকেই চীনের বৈধ কতৃপক্ষ বলে স্বীকৃতি দেয়, এবং এমন ভাব করে যে মূল ভূখণ্ডে প্রতিষ্ঠিত কমিউনিস্ট চীন আসলে ‘মিডিয়ার সৃষ্টি’। এর কোন অস্তিত্ব নেই। এমনকি জাতিসংঘের দেয়া ভেটো ক্ষমতা, অর্থাৎ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদও তাইওয়ানের হাওয়ালায় ছেড়ে দেয়া হয়।

বিগত শতকের ষাটের দশক থেকে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। বাস্তবতাকে স্বীকার করে পশ্চিমা অক্ষ নকল চীনকে নিয়ে পড়ে না থেকে আসল চীনের সাথেও কার্যকরী কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে প্রয়াসী হয়। নিজে থেকে এগিয়ে গেলে মুখ রক্ষা হয়না, তাই আমেরিকা চীনের সাথে বুড়ো আঙ্গুল মেলাতে চীনের সবচেয়ে আজীজ মিত্র পাকিস্তানের শরণাপন্ন হয়। পাকিস্তান তখন সিয়াটো, সেন্টো চুক্তির আওতায় আমেরিকার সাথে অধীনতমূলক মিত্রতায় আবদ্ধ ছিলো।

১৯৬৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে রিচার্ড নিক্সন প্রেসিডেন্ট হবার পর আসল চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে আমেরিকার তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। এই কাজটার দায়িত্ব নেন নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার। তিনি এতোই করিতকর্মা ও প্রভাবশালী হয়ে পড়েন যে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নিয়োগ করা পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স সম্পূর্ণ ব্রাত্য হয়ে পড়েন।

একই সময়ে পাকিস্তানেও ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। প্লুরিসি রোগে নাকাল প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানকে সরিয়ে তখন জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এসেছেন। তিনি পররাষ্ট্র দফতর নিজের হাতে রাখলেও এই সময় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি দেখভালে তাঁর দুই নিকটবর্তী অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস জি এম পীরজাদা ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান অগ্রগণ্য অবস্থানে থাকেন। ইয়াহিয়া খান আমেরিকার সাথে চীনের ভাব করিয়ে দেয়ার দায়িত্ব নেন।

১৯৭১ সালের জুলাইয়ে হেনরি কিসিঞ্জার এক সরকারী সফরে পাকিস্তান যান। সেখান থেকে সারা দুনিয়ার চোখে ধূলা দিয়ে তিনি বেইজিং গমন করেন। গোপন এই সফরে তিনি চীনের সর্বেশ্বর মাও সে তুং এবং প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের সাথে বৈঠক করেন।

সাত মাস পর ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার, পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স, ফার্স্ট লেডী প্যাট নিক্সন সহ এক বিরাট লটবহর নিয়ে চীনের রাজধানী গমন করেন। বেইজিং বিমানবন্দরে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও ফার্স্ট লেডী প্যাট নিক্সনকে স্বয়ং চৌ এন লাইন প্রটোকল দিয়ে এই সফরের উচ্চতা বাড়িয়ে দেন।

পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় হওয়া এই সফরের পর বেইজিংয়ের সাথে ওয়াশিংটনের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়। এমনকি তাইওয়ানের কাছ থেকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী আসনটিও চীনকে ফিরিয়ে দেয়া হয়।

মহাথির মোহাম্মদকে দাওয়াত করে ইসলামাবাদ নেয়া, চীনের সাথে মালয়েশিয়ার বিদ্যমান সম্পর্ক ও পাকিস্তানের সাথে চীনের বিদ্যমান বোঝাপড়ার ত্রিমুখী ট্রেন্ডকে এক সাথে জুড়তে গেলে এই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, চীনা অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ প্রাণ ভ্রমর মালাক্কা প্রণালীর নিগাহবান রাষ্ট্রের সাথে পড়তি বোঝাপড়া ঝালাইয়ে বেইজিং কি ইসলামাবাদের সাহায্য নিতে চায়?

সময় যতো গড়াবে, ততোই এটা স্পষ্টতা পাবে। এই মুহূর্তে বোধকরি আমি বাদে খুব কমই এই বিষয়টা নিয়ে কোন পাবলিক ডোমেইনে মত ব্যক্ত করেছে…!

©

উপরের ছবি- গতকাল রাতে রাওয়ালপিন্ডির নূর খান বিমানঘাঁটিতে অবতরণের পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশীর সাথে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মহাথির মোহাম্মদ।

নিচের ছবি- ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী বেইজিংয়ে অবতরণ করার পর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও ফার্স্ট লেডী প্যাট নিক্সনকে প্রটোকল দিচ্ছেন কমিউনিস্ট চীনের দুই প্রবাদ পুরুষের একজন প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ওই সফরকে যেকোন কিছুর নিরিখেই একটি সত্যিকারের ঐতিহাসিক সফর বলা চলে, যা ওয়াশিংটনের এশীয় মিত্র ইসলামাবাদের প্রযোজনায় সম্পাদিত হয়েছিলো।

তবে নিক্সন প্রশাসন এক্ষেত্রে পাকিস্তানকে কেবলই টিস্যু পেপারের মতো ব্যবহার করেছিলো। তখন পাকিস্তান ভাঙ্গনের মুখে ছিলো। মার্কিন প্রশাসন স্রেফ ফাঁকা বুলি আউড়ানো ছাড়া পাকিস্তানের জন্য আর কিছুই করেনি।

Leave a comment