জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অপ্রকাশিত হলফনামা- অপ্রকাশিত ইতিহাসের একটি সংক্ষিপ্ত ময়নাতদন্ত

পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান যেকোনো ইতিহাসেই একজন ধিকৃত চরিত্র। ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর সব হারিয়ে তিনি জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ইতিহাস থেকে চিরতরে হারিয়ে যান। তার শেষ জীবন ছিল অশেষ কষ্টের। ১৯৭৭ সালে জেনারেল জিয়াউল হক ক্ষমতা দখল করে অসুস্থ ইয়াহিয়াকে মুক্তি দেন। জেনারেল ইয়াহিয়া শেষ জীবনে কপর্দকশূন্য অবস্থায় লাহোরে ছোট ভাইয়ের বাড়ীতে আশ্রিত অবস্থায় দিন কাটান। এসময় তিনি ছিলেন পক্ষাঘাতগ্রস্থ। মৃত্যুর আগে দীর্ঘদিন তিনি বিছানায় জীবন্মৃত অবস্থায় থাকেন। এসময় তিনি কোন কথা বলতে পারতেন না, কোন অঙ্গ সঞ্চালনা ও কাউকে চিনতেও পারতেন না। কেবল শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতেন। ১৯৮০ সালের ১০ আগস্ট ইয়াহিয়া খান মারা যান।

১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়ার অব্যবহিত পূর্বে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যার জন্য ভুট্টো দায়ী। এরপর তার নিজ পৌরোহিত্যে সংঘটিত পাকিস্তানের পতনের ব্যাপারে তার আর কোন বক্তব্য শোনা যায়নি। তবে গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি পাবার পর ১৯৭৮ সালে স্বীয় আইনজীবী মনজুর আহমদ রানার মাধ্যমে লাহোর হাইকোর্টে তিনি একটি হলফনামা দাখিল করেন, যাতে ১৯৭১ সালে সংঘটিত বিভিন্ন গোপন ঘটনার উল্লেখ করা ছিল। ইংরেজিতে টাইপ করা ৫৭ পাতার এই হলফনামা ২০০৫ সালের ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত গোপন রাখা হয়। হলফনামাটি ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারীতে বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নাল অনুবাদসহ প্রকাশ করে।

আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, পুরো হলফনামায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি ইয়াহিয়া খানের খুব একটা উষ্মা প্রকাশ পায়নি! উল্টো ইয়াহিয়া একেবারে স্পষ্ট ভাষায় শেখ মুজিবকে ভুট্টোর চেয়ে অনেক বেশি দেশপ্রেমিক ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ বলে উল্লেখ করেছেন! অন্যদিকে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে তিনি ‘অমসৃণ ত্বক বিশিষ্ট বিষধর ব্যাঙ ধাঁচের প্রাণী’ নামে আখ্যায়িত করেছেন। পুরো হলফনামাতেই নিদর্শন আছে জুলফিকার আলী ভুট্টো কিভাবে ইয়াহিয়া খান, সামরিক বাহিনী ও পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষকে নিজের অঙ্গুলি হেলনে নাচিয়েছেন। সাথে সাথে উন্মেষ হয় ৭১ সালের মূল কসাইয়ের এক ভয়াবহ খল রূপ।

বস্তুত, জেনারেল ইয়াহিয়া খান, জেনারেল টিক্কা খান বা অন্যান্য সকল পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীর পেছনে মূল ইন্ধনদাতা ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। এই কুটিল সিন্ধী ব্যারিস্টার নিজের ক্ষমতার জন্য সজ্ঞানে পাকিস্তানের বিভক্তি হতে দিয়েছেন। তবে পাকিস্তানের অনেকেই যে বিষয়টা আঁচ করতে পারেনি, এমন নয়। আমি ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি, ক্ষমতা দখলের পর জেনারেল জিয়াউল হক হয়তো ভুট্টোকে প্রাণে নাও মারতেন, কিন্তু ভুট্টোর মৃত্যুদণ্ডের মূল কারণ হচ্ছে ১৯৭১ সালের তার ভূমিকা, যা অন্তত জিয়াউল হক বুঝেছিলেন।

হলফনামায় ইয়াহিয়া খান যেসব বিষয়ে আলোকপাত করেছেন, তার সংক্ষিপ্তসার হচ্ছে-

* ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে লিখেছেন, “মুজিব নন, ভুট্টোই পাকিস্তান ভেঙ্গেছেন। ৭১ সালে ভুট্টো যেসব কথা বলেছেন, যে ধরণের গোঁয়ার্তুমি দেখিয়েছেন- পাকিস্তানের সংহতি বিনাশে তা ছিল ছয় দফার তুলনায় অনেক বেশি বিধ্বংসী।”

* ভুট্টো ৭১ সালের মার্চে ঢাকায় আহূত নবগঠিত জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের উদ্বোধনী অধিবেশনে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানালেও এই পরিকল্পনা নাকি ১৯৭০ সালের শেষ দিকেই করা হয়েছিলো। জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত করলে বাঙ্গালীর সহিংস প্রতিক্রিয়াকে ইয়াহিয়া খান ক্ষুব্ধ বাঙ্গালীর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া বলে অভিহিত করেছেন।

* ইয়াহিয়ার মতে বাঙ্গালী খুবই স্পর্শকাতর জাতি, যারা ভালবাসা ও ঘৃণা উভয় ক্ষেত্রেই কোন পরিমাপ করেনা।

* অপারেশন সার্চ লাইট ইয়াহিয়ার একক অনুমোদনেই হয়েছিলো, এবং ভুট্টো এতে খুবই খুশি হয়েছিলেন ও আনুষঙ্গিক পরামর্শও দিয়েছেন। তবে শেখ মুজিবকে জীবিত কিংবা মৃত ধরে আনার আদেশ দিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর ও পূর্বাঞ্চলীয় কম্যান্ডের সর্বাধিনায়ক জেনারেল টিক্কা খান।

* শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবীনামায় প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজনে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু ছয় দফা নিয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বে মতপার্থক্য ছিল। ডঃ কামাল হোসেন, তাজউদ্দীন আহমদ ও খন্দকার মুশতাক আহমদ ভিন্ন মত নিয়ে প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করেছিলেন।

* ইয়াহিয়ার দাবী, তিনি ছয় দফা নিয়েই পাকিস্তানের সংকট নিরসনে আগ্রহী ছিলেন। এমনকি তিনি ছয় দফার উপর নাকি গণভোট নেয়ারও পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিব এতে আগ্রহী ছিলেন না। তাঁর ধারণা ছিলো ছয় দফা গণভোটে প্রত্যাশিত সমর্থন লাভ করতে পারবে না।

* পাকিস্তান ভেঙ্গেছে ভুট্টোর ক্ষমতা লিপ্সার জন্য। আর এই কাজে তাকে সাহায্য করেছিলেন পাকিস্তানের সেনা ও বিমানবাহিনীর কিছু শীর্ষ কর্মকর্তা। এদের মধ্যে প্রধান ছিলেন সেনাবাহিনীর চীফ অভ জেনারেল স্টাফ জেনারেল গুল হাসান খান ও বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল আবদুর রহিম খান। এছাড়াও প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল সৈয়দ গোলাম মোহাম্মদ পীরজাদা সামরিক বাহিনী ও ভুট্টোর আঁতাতের সমন্বয়ক ছিলেন। রহিম খান যুদ্ধের সময় বিমানবাহিনীকে কার্যত নিষ্ক্রিয় করে রাখেন। ভুট্টোর আদেশেই তিনি নিষ্ক্রিয় থাকেন। তিনি প্রেসিডেন্টকে বলেন, জঙ্গিবিমানের খুচরা যন্ত্রাংশ নেই, জ্বালানী তেলও নেই।

* উভয় রণাঙ্গনে যেন পাকিস্তানের হার অবধারিত হয়, সেটা নিশ্চিত করা হয় খোদ পাকিস্তানী জেনারেলদের দ্বারাই।

* ১৯৭১ সালের শুরু থেকেই পাকিস্তানের সকল গোয়েন্দা সংস্থা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। মূলত নির্বাচনোত্তর ভবিষ্যৎ প্রশাসন সম্পর্কিত অনিশ্চয়তার কারণেই তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। কেবল মিলিটারি ইন্টিলিজেন্সই সক্রিয় ছিল। অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার নিষ্ক্রিয়তার কারণে তাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে সকল রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা তৎপরতা চালাতে হয়, যা পাকিস্তানের সামগ্রিক পতনের জন্য বহুলাংশে দায়ী।

* ইয়াহিয়ার কাছ থেকে ক্ষমতা নেয়ার পর সামরিক বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ে প্রায় সবাইকে বরখাস্ত করলেও বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল রহিম খান স্বপদে বহাল থাকেন, গুল হাসান খান নতুন প্রধান সেনাপতি হন। অবশ্য কিছুদিন পরই ভুট্টো নিজ বাড়ীতে নৈশভোজের নামে তাদের ডেকে নিয়ে পিপিপির সশস্ত্র ক্যাডারদের হাতে তাদের বন্দী করিয়ে রেডিও ভাষণ দিয়ে তাদের পদচ্যুত করার ঘোষণা দেন।

* যুদ্ধের শেষে মার্কিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় কম্যান্ডের সপ্তম নৌবহরের আগমন ও উত্তর দিক থেকে চীনের আক্রমণের ব্যাপারটা পুরাই ধাপ্পাবাজী ছিল।

* পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার পরও হঠাৎ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কতৃক পশ্চিম রণাঙ্গনেও একতরফা যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয়া ভুট্টো-ইন্দিরা গোপন আঁতাতেরই ফল।

* সেপ্টেম্বরের শেষেই শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে অত্যন্ত নমনীয় এক কনফেডারেশনের মাধ্যমে পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে নামমাত্র ও আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক রেখে পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান। কিন্তু ভুট্টো ও জেনারেলরা নিত্যনতুন ইস্যু হাজির করিয়ে ইয়াহিয়াকে ছাগল বানান, ফলে তিনি পথভ্রষ্ট হয়ে বেদিশা হয়ে পড়েন। ভুট্টো আর জেনারেলরা পাকিস্তানের চূড়ান্ত পরাজয়ই চাইছিলেন, যাতে ভবিষ্যতে একে পুঁজি করে তারা সংঘবদ্ধভাবে দীর্ঘদিন ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে পারেন।

আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এক্ষেত্রে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হলফনামার বক্তব্যের সাথে লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী, মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর বইয়ের বক্তব্য কার্যত একই। প্রত্যেকেই শেখ মুজিবুর রহমানের চেয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে অনেক বেশি খল হিসেবে প্রতিপন্ন করেছেন, এবং মূল নাটের গুরু হিসেবে অভিহিত করেছেন…।

সোহাগীর খুন, কুমিল্লা সেনানিবাস এবং প্রাসঙ্গিক কথা

গত রবিবার অর্থাৎ ২০ মার্চ তারিখে কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের এক ছাত্রীর লাশ উদ্ধার হয়। মেয়েটিকে বলৎকারের পর অত্যন্ত নৃশংস উপায়ে খুন করা হয়। হত্যার ধরণটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সোহাগী নামের সেই মেয়েটির উপর এমন অনাবশ্যক নিপীড়ন করা হয়েছে, যা বিশ্লেষণ করলে একে নেহায়েত একটি ‘ওয়াক ইন রেপ’ বলে মনে হয়না। এই পয়েন্টটি খেয়াল রাখার মতো।

যাহোক, অনলাইনে এই ব্যাপারে হেলদোল শুরু হয় আরও পরে। ঘটনাটি আমার গোচরীভূত হয় মঙ্গলবার। তখনও মূলধারার প্রচারমাধ্যমে সোহাগীর কোন খবর আসেনি। মঙ্গলবার স্রেফ অনলাইনে একজন হিজাবী মেয়ের নৃশংস হত্যার ব্যাপারে তথাকথিত প্রগতিশীল ও নারীবাদীদের শীতল মনোভাব নিয়ে কটাক্ষ চলছিলো।

কিন্তু বুধবার, অর্থাৎ গতকাল থেকেই আমার নজরে এলো সোহাগীর ব্যাপারে না হোক, সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বিষয় নিয়ে অনলাইনে নতুন মুদ্দা খাড়া করানো হলো। কিছু পরিচিত ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে সোহাগীর হত্যার পেছনে সেনাবাহিনীকে দায়ী করার চেষ্টা করতে দেখা গেলো। প্রথমে যদিও কেবল সেনানিবাসের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সেনাবাহিনীর ব্যর্থতার আরোপ দেয়া হয়েছিলো। দিন গড়াতে গড়াতে দেখা গেলো, অনেকেই বলতে চাইছেন, সেনাবাহিনীই সোহাগীর ধর্ষণ ও হত্যার পেছনে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী।

কুমিল্লা সেনানিবাসের ভৌগলিক অবস্থিতি

সেনাবাহিনী এই ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত কী না, সেটা নিয়ে কিছু বলা অর্থহীন। তবে সেনানিবাসের নিরাপত্তা বিধানে সেনাবাহিনীর উপর ঢালাও আরোপ দেয়ার আগে আমাদের জানতে হবে কুমিল্লা সেনানিবাস ও এর প্রকৃতি সম্পর্কে। এই সেনানিবাসের সাথে অন্য সেনানিবাসের মূল পার্থক্য হচ্ছে, এর বুক চিরে চলে গেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও সিলেট-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। সিলেট অভিমুখী সড়কটি সেনানিবাসের ভেতরেই চট্টগ্রাম অভিমুখী গ্র্যান্ড ট্রাংক রোডের সাথে যুক্ত হয়েছে। ষ্টেশন সদরদফতর থেকে শুরু করে বেশ কিছু স্থাপনার অবস্থান একেবারেই মহাসড়কের লাগোয়া। সেনানিবাসের মধ্যে অথবা গা ঘেঁষেই রয়েছে বেসামরিক বাজার, আবাসিক এলাকা; যা সেনানিবাসের নিরাপত্তায় বাড়তি ঝুঁকি আরোপ করে। এমন স্থানে বিশেষ নিরাপত্তা প্রদান করা যেমনি দুরূহ, তেমনি তা নিশ্চিত করতে গেলেও বেসামরিক প্রশাসনের সাথে সেনা প্রশাসনের টানাপড়েন শুরু হয়ে যায়। মোটকথা, এই সেনানিবাসে গেট দিয়ে, চেকপোস্ট বসিয়ে যদি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যাওয়া হয়, তবে মহাসড়কগুলো যানজটে ফেঁসে থাকবে সর্বদা। যারা এই বিষয়টা সম্পর্কে অবগত, তারা নিরাপত্তার শৈথিল্যের জন্য সেনাবাহিনীকে দায়ী করার আগে দুইবার ভাববে।

কুমিল্লা সেনানিবাস নামে সমধিক পরিচিত ময়নামতি সেনানিবাস প্রথম স্থাপিত হয় ১৯৪৩ সালে কুমিল্লা শহর থেকে খানিকটা উত্তরপশ্চিম দিকে। এটি স্থাপিত হয়েছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় জাপানের বিরুদ্ধে মিত্রশক্তির যুদ্ধ প্রচেষ্টায় মোতায়েন করা ব্রিটিশ চতুর্দশ আর্মির প্রধান সেনাপতি জেনারেল উইলিয়াম স্লিমের সদর দফতর হিসেবে।

যুদ্ধের পর এই সেনানিবাস কার্যত বিরানই পড়ে থাকে। ১৯৪৭ সালে পূর্ববঙ্গের প্রধান সেনাধ্যক্ষের দায়িত্বে থাকা পরবর্তীতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মুহম্মদ আইয়ুব খানের ‘ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্স’ বই থেকে জানা যায়, পাকিস্তান আমলের শুরুর দিকেও কুমিল্লা সেনানিবাস সম্পর্কে তিনি ভাবেন নি। তিনি বরং ঢাকার উত্তর দিকে রাজেন্দ্রপুরেই নতুন সেনানিবাস গঠনের উদ্যোগ নেন। পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে ময়নামতিতে প্রথম একটি সেনাদল মোতায়েন করে পাকিস্তান। তবে এটি একটি ক্ষুদ্র লাইট ইনফ্যান্ট্রি ইউনিটের চেয়ে বেশি কিছু ছিলোনা।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর প্রথমে ময়নামতি সেনানিবাসে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমী স্থাপন করা হয়। তবে ১৯৭৬ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমান ময়নামতি থেকে মিলিটারি একাডেমী সরিয়ে নিয়ে রক্ষীবাহিনী থেকে উদ্ধার করা ভাটিয়ারীতে তা স্থানান্তর করেন। এভাবেই কুমিল্লায় গড়ে ওঠে আজকের ৩৩ পদাতিক ডিভিশন।

আমি কুমিল্লা জেলারই সন্তান। ছোটবেলা থেকেই কুমিল্লা সেনানিবাস সম্পর্কে অনেক অলীক শিশুতোষ গল্প শুনেছি। যেমন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সব গোলাবারুদ নাকি এই সেনানিবাসে মাটির নিচে ভল্টে সংরক্ষণ করা হয়। এখানে এমন সংখ্যক বারুদ আছে, যা দিয়ে নাকি পুরা কুমিল্লা শহর উড়িয়ে দিয়ে একটি প্রকাণ্ড দীঘির জন্ম হতে পারে!

কুমিল্লা সেনানিবাসের কৌশলগত বিশেষত্ব

তবে নানান গাঁজাখুরি গল্পের যোগান দিলেও কুমিল্লা সেনানিবাস সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে তথ্য বেশিরভাগেরই অজানা তা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে মাত্র পাঁচ মাইল দূরে অবস্থিত এই সেনানিবাসই বাংলাদেশের একমাত্র আক্রমণাত্মক সামরিক স্থাপনা। বাকি সব সেনাছাউনি সীমান্ত থেকে দূরে, মূলত রক্ষণাত্মক অবস্থানে অবস্থিত। বলা বাহুল্য, সীমান্তের লাগোয়া একটা আস্ত পদাতিক ডিভিশন পাক-ভারত সীমান্তে দেখা যায়, কারণ সেই সীমান্তে সবসময়ই যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করে। সীমান্তের এতো কাছে এতো বড় সেনাদল রাখা এমনিতেও দুনিয়াতে বেশ কমই দেখা যায়। আর এটাই কুমিল্লা সেনানিবাসের মূল কৌশলগত গুরুত্ব।

সম্ভবত এই কারণেই, বাংলাদেশের অন্য যেকোনো সেনানিবাসের তুলনায় ময়নামতি সেনানিবাসে অন্তর্ঘাতমূলক ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। সেনানিবাস আর ভারতের প্রায় মাঝামাঝি বয়ে চলেছে গোমতী নদী। পাকিস্তান আমল থেকেই প্রায়শই বর্ষার সময় সেনানিবাস লাগোয়া গোমতী নদীর বাঁধ কোন কারণ ছাড়াই কেটে যেতো, যাতে পাহাড়ের উপর স্থাপিত ক্যান্টনমেন্ট না হলেও এর চারিদিক প্লাবিত হয়ে যাতে এটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিগত শতাব্দীর শেষ দিক পর্যন্ত বর্ষা এলেই নদীর বাঁধ ভেঙ্গে যাবার এই সিলসিলা জারী ছিল। কুমিল্লা শহরের বেশিরভাগ তরুণের হয়তো এই তথ্য জানা নেই।

সেনানিবাসের নিরাপত্তা সংহত করতে আগে গৃহীত ব্যর্থ পদক্ষেপ

আগেই লিখেছি, কুমিল্লা সেনানিবাস অন্যান্য সেনানিবাসের চেয়ে অধিক পরিমাণে বেসামরিক আবাদি দ্বারা ঘিরে আছে। নিয়ম অনুযায়ী, সেনানিবাসের নিজস্ব এলাকা তো বটেই, তার চতুর্দিকেও দেড়শ গজ চওড়া জমি চ্যাপ্টার্ড এরিয়া হিসেবে খালি রাখতে হয়, যাতে যুদ্ধ বা শান্তিকালীন উভয় সময়েই সেনানিবাসের নিরাপত্তা সংহত রাখা সম্ভব হয়। গত শতকের শেষের দশকে সেনানিবাসের সীমানা নির্ধারণ বিষয়ে নিষ্পত্তির জন্য উচ্চ আদালতে মামলা চলমান ছিল। ২০০০ সালে এই মামলায় সেনাবাহিনী জয়লাভ করলে সেনানিবাসের চারিদিকে চ্যাপ্টার্ড এরিয়া সহ নিরাপত্তা সংহত করার কাজ শুরু হয়। এর জন্য সেনানিবাসের ফটকসমূহ রাত বারোটার পর বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

কিন্তু এই সিদ্ধান্ত প্রবল বাঁধার সম্মুখীন হয়। বেসামরিক লোকজন এ নিয়ে হাঙ্গামা শুরু করে। তৎকালীন জিওসির কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়ে প্রতিবাদ ও দুয়োধ্বনিও চলে। পরিস্থিতি বেগতিক হয়ে পড়লে খোদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ওয়াজেদকে এতে হস্তক্ষেপ করতে হয়। এক পর্যায়ে সাধারণ জনগণের বাঁধার মুখেই সেনা কতৃপক্ষ বাধ্য হয় সেনানিবাসের প্রার্থিত নিরাপত্তা শিথিল করতে।

এরপর ২০১০-১১ সালেও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চওড়া করার সময় বেসামরিক ও সামরিক প্রশাসনের মধ্যে চাপানউতোর হয়। সেনাবাহিনী বিকল্প প্রস্তাব হিসেবে সেনানিবাসে ভারী যানবাহন ও জনগণের গমনাগমন কমাতে সেনানিবাসের দুই দিকে দিয়ে মহাসড়ক টানার প্রস্তাব করেছিলো।

একটি ভিন্নমতাবলম্বী বিশ্লেষণ

যাহোক, এতো কিছুর পরও সোহাগী হত্যাকাণ্ডই এখানে আলোচ্য মূল বিষয়। আমি আগেই বলেছি, সোহাগীকে হত্যার ধরণ, হত্যাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত সংঘবদ্ধ প্রতিক্রিয়ার ধাঁচে তাৎপর্যপূর্ণ কিছু বিবেচ্য বিষয় আছে। প্রথমত, সোহাগীর লাশ সেনানিবাসের এলাকাতে পাওয়া গেলেও তাকে সেনানিবাসেই খুন করা হয়েছে কিনা, সে ব্যাপারে কিছু জানা যায়না। যতদূর জানি, সোহাগীর লাশ সেনানিবাসের অভ্যন্তরের কোন সংরক্ষিত এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়নি, বরং সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত এক রাস্তায় এক কালভার্টের নিচে পাওয়া গেছে। যদি এর সাথে সেনাবাহিনীর কেউ জড়িত থাকতো, তাহলে প্রথমত লাশ খুঁজেই পাওয়া যেতো না, এবং দ্বিতীয়ত, যদি খুঁজেও পাওয়া যেতো, তবে এমন কোন স্থানেই তা পাওয়া যেতো, যেখান থেকে সেনাবাহিনী বা সেনানিবাসের গায়ে আঁচড় লাগার সুযোগ সৃষ্টি না হয়।

সোহাগীর বিষয়ে সেনাবাহিনীর নীরবতা কি রহস্যময়?

যারা সোহাগীর বলৎকার ও খুনের ঘটনায় সেনাবাহিনীকে অভিযুক্ত করছে, তাদের সবাই এক্ষেত্রে মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে এই ঘটনার বিষয়ে সেনাবাহিনীর নীরবতার দিকে ইঙ্গিত করছে। যদি নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে সেনা কতৃপক্ষ নীরবতার আশ্রয় নিতো, তাহলে আমি তাকে একটি পেশাদার বাহিনীর চরম অপেশাদার আচরণ হিসেবেই ধরে নিতাম। কিন্তু আমার সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান অনুযায়ী এধরণের কাঁচা কাজ তারা করতো না। বস্তুত, সামরিক বাহিনী গণযোগাযোগের দিক থেকে যথেষ্ট কাঁচা। এর কারণ নিহিত আছে আমাদের সেনাবাহিনীর রক্তাক্ত ইতিহাসে। পৃথিবীতে এখনও টিকে থাকা আধুনিক জাতীয় সেনাবাহিনীসমূহের মধ্যে খুব কম সেনাবাহিনীই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মতো এমন রক্তপাত অতিক্রম করতে পেরেছে। বিগত শতকের সত্তুরের দশকের পুরোটাই এই বাহিনী আত্মঘাতী বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান ও প্রচুর অনাকাঙ্ক্ষিত রক্তক্ষয়ের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে।

এমনিতেই প্রকৃতিগতভাবে সামরিক বাহিনী গণযোগাযোগের দিক থেকে অপেক্ষাকৃত অনুদার। তার উপর অতীতে এতো রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থান সামলাতে গিয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে গণযোগাযোগ এড়িয়ে যাবার সাধারণ প্রবণতা দেখা যায়। এছাড়াও বেসামরিক শাসনের সময় যথাসম্ভব নিজেদের বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার প্রবণতাও সেনাবাহিনীর এই নীরবতার পেছনে দায়ী। গণযোগাযোগের কৌশল সম্পর্কে ধারণাগত সীমাবদ্ধতার কারণেই সেনা সদর থেকে কিছু ব্যক্তি ও প্রচারমাধ্যমকে কুমিল্লা সেনানিবাসের ঘটনায় সংযম অবলম্বনের জন্য সেনা সদর থেকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

বাইরের কোন কারণ কি জড়িত থাকতে পারে?

এমনও হতে পারে, সোহাগীর খুন আসলে পুরো দৃশ্যপটে একটি গৌণ ও সহযোগী বিষয়। দুই দিন আগেও পত্রিকায় দেখলাম, প্রায় ৯২ বছরের পুরানো সামরিক বিধি বদলে সেনানিবাসের স্থাবর সম্পত্তির উপর সামরিক কতৃপক্ষের বদলে বেসামরিক কতৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার বিষয়ে একটি আইনের খসড়া সশস্ত্র বাহিনীর আপত্তির মুখে মন্ত্রীসভা ফিরিয়ে দিয়েছে। এই আইন বলবত হলে সেনানিবাসসমূহের ভূসম্পত্তির উপর সামরিক ভূমি ও সেনানিবাস অধিদফতর এবং ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডসমূহের নিয়ন্ত্রণ কমে যাবে। এই উদ্যোগের পেছনে কে দায়ী, সেটা না জানা গেলেও সরকার এটির নথি ফিরিয়ে দিয়ে উচিত কাজই করেছে।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে, সেনানিবাসের নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে মানুষের মনে সেনাবাহিনী সম্পর্কে বিরূপ ধারণার জন্ম দিয়ে এই আইন গ্রহণে সরকার বা সামরিক বাহিনীকে মনস্তাত্ত্বিক চাপ প্রয়োগ করা, এবং ক্ষেত্রবিশেষে মানুষের সমর্থন ছিন্ন করিয়ে বাড়তি ফায়দা লাভের উদ্দেশ্যে কি সোহাগী হত্যার প্রসঙ্গকে কাজে লাগানো হচ্ছে?

উপসংহার

সোহাগীর খুনের সামনে-পেছনের অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে আমার ধারণা দিলেও এই বিষয়ে খোদ আমি নিজেই নিশ্চিত নই। তবে এই বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ, যে এই হত্যার বিচার হতে হবে। ফুটফুটে মেয়েটি বয়সে আমার ছোট বোনের মতো। যে বা যারা এর জন্য দায়ী, তার চূড়ান্ত শাস্তি ছাড়া আর কোন কিছু আমার কাম্য হতে পারেনা। তবে উপরিউক্ত বিষয়সমূহ মদ্দেনজর করলে আমার একটা আশা থাকবে যে, আমরা সাধারণ মানুষ যেন এই হত্যাকাণ্ডের উসিলায় আরেকটি আত্মঘাতী কদম না ফেলি। একটি ফুটফুটে মেয়ের খুনের বদলা যেন কোনোভাবেই জাতীয় প্রতিরক্ষার জন্য অত্যন্ত কৌশলগত একটি সেনানিবাস তথা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য কোন লিঞ্চিং মবে পরিণত না হয়। যাদের জন্য বিদেশে বাংলাদেশ বিরলতম কিছু সম্মান, শ্রদ্ধা ও মর্যাদায় ভূষিত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে বাংলাকে একটি দূরদেশ কতৃক সম্মানসূচক রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রদান; তারা আমাদের কাছে ন্যূনতম দায়িত্ববোধ প্রত্যাশা করতেই পারে।

যখন আমি এই লেখার মুসাবিদা করছি, তখন ক্যালেন্ডারের পাতায় এসেছে ২৫ মার্চ। এই রক্তস্নাত দিনের কসম, আমাদের বুঝতে হবে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী আর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কোনোভাবেই এক নয়। যারা এমন তত্ত্ব প্রচার করে, তাদের সদুদ্দেশ্য সম্পর্কে আমার ভরপুর সন্দেহ আছে। সেনাবাহিনী দেখলেই নাক উঁচু করা তাদের সাজে, যাদের সাথে সেনাবাহিনীর গোষ্ঠীগত বিবাদ রয়েছে। একজন তরুণ, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের সাথে সেনাবাহিনীর কোন গোষ্ঠীভিত্তিক দ্বন্দ্ব থাকতে পারে না। বরং তরুণদের থাকতে হবে একটি সচেতন ও সচল বর্ম হিসেবে, যা বর্মে রাষ্ট্রবিরোধী যেকোনো প্রচেষ্টা প্রতিহত করবে।

ব্যক্তিগতভাবে আমি কোন দিক থেকেই সেনাবাহিনীর সুবিধাভোগী নই। আমার তেমন কোন রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়স্বজনও সামরিক বাহিনীতে কর্মরত নেই, যে আমি গোষ্ঠীগত স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সেনাবাহিনীর পক্ষে ওকালতি করতে নেমেছি। আমি বাংলাদেশকে মধ্যযুগে আড়াই শতাব্দী যাবত বলবত সমৃদ্ধশালী স্বাধীন বাংলা সালতানাতের ভাবগত উত্তরসূরি হিসেবেই দেখি। আমার এই দৃষ্টিকোণ একজন পুনরুজ্জীবনবাদীর দৃষ্টিকোণ। একজন পুনরুজ্জীবনবাদী হিসেবে নেহায়েত দেশপ্রেমের বশবর্তী হয়েই আমি এই দীর্ঘ আলোচনাটির অবতারণা করলাম…।

রাজকোষ কেলেঙ্কারি বিষয়ে অর্থমন্ত্রী মুহিতের বেফাঁস সাক্ষাৎকার

অদূর ভবিষ্যতে হয়তো সাক্ষাৎকারটি গুম হয়ে যাবে। তাই এটিকে এখানে হুবহু কপিপেস্ট করে রাখার তাড়না বোধ করছি। সাক্ষাৎকারের পর এর সম্পর্কে জিয়া হাসান নামের এক ব্যক্তির বিশ্লেষণও হুবহু কপি করে দিচ্ছি। সাক্ষাৎকারটি ১৮ মার্চ ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয়-

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা অবশ্যই জড়িত। তাঁদের যোগসাজশ ছাড়া এ কাণ্ড হতে পারত না। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথমআলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। সাক্ষাৎকারে উঠে আসে সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানের পদত্যাগের পটভূমি, ব্যাংক ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা ও অনিয়মের চিত্র। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও ফখরুল ইসলাম

প্রথম আলো: রিজার্ভ চুরির ঘটনা জানার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। ডেপুটি গভর্নরদেরও সরিয়ে দিলেন। খুব ত্বরিত ব্যবস্থা নিলেন বলে মনে হচ্ছে।

অর্থমন্ত্রী: হ্যাঁ। কিন্তু আমি খুব অবাক হয়েছি। আতিউর রহমান সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তিনি একটুও লজ্জিত হননি।

প্রথম আলো: সংবাদ সম্মেলন করেছেন, না ব্যাখ্যা দিয়েছেন?

অর্থমন্ত্রী: ব্যাখ্যা না, সংবাদ সম্মেলনই করেছেন। বাড়িতে করেছেন এবং দুই দফা। একবার পদত্যাগের আগে, আরেকবার পদত্যাগের পর। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিনি ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেক কথা বলেছেন। দুজন ডেপুটি গভর্নরের চাকরি গেছে তাঁর কারণে। বোঝাতে চাইলেন যে তিনি একা দায়ী নন। দুজনের বাইরে আরও কয়েকজনের চাকরি খাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তা আর হয়নি, হবেও না।

প্রথম আলো: নতুন গভর্নর তো নিয়োগ দিলেন। টাকা উদ্ধারে কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন?

অর্থমন্ত্রী: টাকা আসলে উদ্ধার হবে কি না, আমি নিশ্চিত না। কিছু টাকা পাওয়া গেছে বরং শ্রীলঙ্কার কল্যাণে।

প্রথম আলো: চুরির ঘটনা জানার পর আতিউর রহমান কী করেছিলেন বলে আপনি শুনেছেন?

অর্থমন্ত্রী: কী বলব। তিনি সংকটটির গভীরতাই বুঝতে পারেননি। আমার মনে হয়, তিনি চিন্তাই করতে পারেননি যে এটা একটা বড় ঘটনা। খবর পেয়েও তিনি দেশের বাইরে বাইরে ঘুরেছেন।

প্রথম আলো: দিল্লির বৈঠকে তো আপনারও যাওয়ার কথা ছিল।

অর্থমন্ত্রী: এটা মূলত অরুণ জেটলির (ভারতের অর্থমন্ত্রী) দাওয়াত ছিল। আমাকেও দাওয়াত দিয়েছিলেন তিনি। যাব চিন্তা করেও পরে যাইনি।

প্রথম আলো: আতিউর রহমানের সাফল্যও তো কিছু কম নয়…

অর্থমন্ত্রী: কেন্দ্রীয় ব্যাংকে তাঁর অবদান প্রায় শূন্য (অলমোস্ট জিরো)। তিনি খালি পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েছেন আর লোকজনকে অনুরোধ করেছেন বক্তৃতা দেওয়ার জন্য তাঁকে সুযোগ দিতে ও দাওয়াত দিতে। এখন বেরোচ্ছে এগুলো।

প্রথম আলো: গ্রিন ব্যাংকিং, কৃষকদের জন্য ১০ টাকার হিসাব খোলার সুযোগ ইত্যাদি তো সাফল্যই।

অর্থমন্ত্রী: এগুলো স্লোগান। তিনি খালি পিআরের (জনসংযোগ) কাজ করেছেন। এসব নিয়ে বাজারে অনেক কথাও আছে।

প্রথম আলো: আতিউর রহমান বলার চেষ্টা করেছেন যে বেসিক ব্যাংক, হল-মার্ক কেলেঙ্কারির ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেছিলেন।

অর্থমন্ত্রী: না, না। এগুলো ইতিমধ্যে বহুল আলোচিত বিষয়। বেসিক ব্যাংক পুরোনো বিষয়। বেসিক ব্যাংকের ওপর প্রথম নিরীক্ষা প্রতিবেদনটা ভালো ছিল। তারপর তো বাংলাদেশ ব্যাংকই সব ধামাচাপা দিয়ে দিল।

প্রথম আলো: আপনি কিন্তু বলেছিলেন বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন, পরে আর নেননি।

অর্থমন্ত্রী: হ্যাঁ, বলেছিলাম। ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এখনো হয়নি। যাই হোক। রাজনৈতিক ব্যাপার-স্যাপার সব আলাপ করা যায় না। তবে ব্যবস্থা ঠিকই নেওয়া হবে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিষয়টা ঠিকভাবে দেখভাল করতে পারেনি। যখন আদালতে যাবে, আদালত ঠিকই সব জানতে চাইবে এবং তখন ওই লোকটার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা হবে।

প্রথম আলো: আর হল-মার্ক?

অর্থমন্ত্রী: হল-মার্ক বিষয়ে মামলা আছে। আমার মনে হয়, আমাদের উকিলরা বিষয়টিতে খুব একটা মনোযোগী নন।

প্রথম আলো: ব্যাংক-ব্যবস্থার সার্বিক নিরাপত্তার জন্য কী করছেন?

অর্থমন্ত্রী: কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ব্যাপক সংস্কার দরকার। এর ব্যবস্থাপনা অদক্ষ। গভর্নরের কথা যদি বলি, তিনি জনসংযোগেই বেশি ব্যস্ত ছিলেন, ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিচতলায় যে লেনদেন হয়, তার মুনাফার কোনো হিসাব থাকে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের লোকেরা ভাগ করে নিয়ে যান। আতিউর কোনো দিন এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেননি।

প্রথম আলো: ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে যেখানে হাজার কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে, সেখানে ৪-৫ হাজার টাকা তো তেমন কিছুই না।

অর্থমন্ত্রী: দৈনিক যাচ্ছে! বাংলাদেশ ব্যাংক হবে নির্জন জায়গা। আগে তাই দেখেছি। অথচ এখন তা বিরাট বাজার। নিচতলায় বিরাট কামরায় সরাসরি বাণিজ্যিক কার্যক্রম হচ্ছে; যা আগে করত সোনালী ব্যাংক।

প্রথম আলো: এ ব্যাপারে আতিউর রহমানকে কিছু বলেছেন কখনো?

অর্থমন্ত্রী: বহুবার বলেছি যে, তুমি ব্যাংকিংয়ে মনোযোগ দাও। কিছু বললেই তিনি বলতেন, আমি এটা করেছি, ওটা করেছি। দুই দিন আগেও তিনি বলেছেন, প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভের কৃতিত্ব তাঁর। রিজার্ভের কৃতিত্ব মূলত প্রবাসী শ্রমিকদের।

প্রথম আলো: বেশি রিজার্ভকেও তো অনেকে তেমন গুরুত্ব সহকারে দেখেন না।

অর্থমন্ত্রী: না, টাকা থাকলে ভালো হয়। তবে এ থেকে বিনিয়োগ করা গেলে আরও ভালো হতো। সেটা আমরা করতে পারিনি এখনো।

প্রথম আলো: রিজার্ভ ভালো বলেই কি আমরা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার সাহস পেলাম?

অর্থমন্ত্রী: না। রিজার্ভের সঙ্গে পদ্মা সেতুর কোনো সম্পর্ক নেই। রিজার্ভ ভালো থাকলে প্রবাসীদের মনে আস্থা থাকে যে দেশে টাকা আছে। নইলে তাঁরা অন্য দেশেও টাকা হস্তান্তরের পথ বেছে নিতে পারেন।

প্রথম আলো: রিজার্ভ চুরির ঘটনা কি দেশে টাকা পাঠাতে প্রবাসীদের মনে আস্থার সংকট তৈরি করতে পারে?

অর্থমন্ত্রী: সে রকম কিছু হবে না বলে আমার বিশ্বাস। তাঁরা ঠিকই বুঝবেন যে একটু অব্যবস্থাপনা হয়েছে, ধরাও হয়েছে।

প্রথম আলো: রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটেছে ছুটির দিন শুক্রবারে, তাই পদক্ষেপ নিতে দেরি হয়েছে—আতিউর রহমানের এমন ব্যাখ্যাকে কীভাবে দেখবেন?

অর্থমন্ত্রী: সম্পূর্ণ ভুল ব্যাখ্যা। শুক্রবারেও লোক থাকবে না কেন? ফোন ধরা ও তথ্য দেওয়ার জন্য ছুটির দিনেও লোক থাকা উচিত।

প্রথম আলো: আপনার কি মনে হয়, এই ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদেরও যোগসাজশ রয়েছে?

অর্থমন্ত্রী: অবশ্যই। শতভাগ জড়িত। স্থানীয়দের ছাড়া এটা হতেই পারে না। ছয়জন লোকের হাতের ছাপ ও বায়োমেট্রিকস ফেডারেল রিজার্ভে আছে। নিয়ম হলো, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়—এভাবে ষষ্ঠ ব্যক্তি পর্যন্ত নির্দিষ্ট প্লেটে হাত রাখার পর লেনদেনের আদেশ কার্যকর হবে।

প্রথম আলো: ঘটনার প্রায় এক মাসেও সরকারের শীর্ষ মহলে না জানানোর কারণ হিসেবে আতিউর রহমান নিজে বিভ্রান্ত (পাজল্ড) হয়ে পড়েছিলেন বলে ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

অর্থমন্ত্রী: এটাও ভুল। আমার নিয়োগ করা গভর্নর, অথচ তিনি সব সময়ই বলে এসেছেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁকে নিয়োগ দিয়েছেন। এমনকি পদত্যাগপত্রও তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে দিয়েছেন। এটা তিনি পারেন না। তাঁর পদত্যাগপত্রটিও হয়নি। আমাদের দেশে তো ওইভাবে নিয়মকানুন মানা হয় না, অন্য দেশ হলে তো আমার অনুমতি ছাড়া তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখাই করতে পারতেন না।

প্রথম আলো: এটা কি ‘চেইন অব কমান্ড’ সমস্যা?

*আতিউর পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন
*কেন্দ্রীয় ব্যাংকে তাঁর অবদান প্রায় শূন্য।
*রিজার্ভের কৃতিত্ব তাঁর নয়, প্রবাসী শ্রমিকদের। ​তিনি কেবল জনসংযোগের কাজ করেছেন
*অর্থ উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত নয়

অর্থমন্ত্রী: বটেই। তাঁকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেননি, আমি নিয়োগ দিয়েছি। আমার কাছেই পদত্যাগপত্র দিতে হবে।

প্রথম আলো: সাত বছরে আতিউর কি আপনার পরামর্শ নিয়েছেন?

অর্থমন্ত্রী: নেননি, তবে আমিই পরামর্শ দিয়েছি। মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের একটা ঝামেলা থাকে। এটা ভারতসহ সব দেশেই হয়। আর যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া সবাই মুদ্রানীতি প্রণয়নে হস্তক্ষেপ করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা আছে। সে অনুযায়ী কাজও করেছে সব সময়। মুদ্রানীতি নিয়ে আতিউর যা করেছেন, আমি বরাবরই গ্রহণ করেছি।

প্রথম আলো: এ ক্ষেত্রে কি তাঁকে ক্রেডিট দেবেন?

অর্থমন্ত্রী: ওয়েল। দেব। তবে আমিও একটু বলে নিই। নিজের কথা নিজের বলা উচিত না। বাজেট ব্যবস্থাপনায় গত সাত বছরে আমি যা করেছি, এ ব্যাপারে এই মুহূর্তে আমার চেয়ে বিশেষজ্ঞ দ্বিতীয় ব্যক্তি পৃথিবীতে নেই।

প্রথম আলো: আপনার কথার সূত্র ধরে যদি বলি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান প্রধান কাজ করা থেকে আতিউর অন্য কাজে বেশি মনোযোগী ছিলেন। এতে তো আপনার দায়ও চলে আসে। আপনার নিয়োগ করা গভর্নর…

অর্থমন্ত্রী: যত দূর জানি, আতিউর আর্থিকভাবে সৎ ব্যক্তি। তবে প্রায়ই অভিযোগ করতেন, তিনি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন না। খামোখা! এত বছরে বাংলাদেশ ব্যাংককে মাত্র তিন-চারটা নির্দেশনা দিয়েছি। একবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মিলে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, শেয়ারবাজারে ওভার এক্সপোজার আরও কয়েক বছরের জন্য থাকবে। কিন্তু আতিউর ব্যাংক কোম্পানি আইনে সময়সীমা বেঁধে দিলেন এক বছর। আশ্চর্য কাণ্ড!

প্রথম আলো: ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য প্রাক্-বাজেট আলোচনা তো শুরু করেছেন…

অর্থমন্ত্রী: হ্যাঁ। গতবার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছি। কারণ, এনবিআরের চেয়ারম্যান কোনো কাজ-কাম করেন না।

প্রথম আলো: এখনকার চেয়ারম্যান?

অর্থমন্ত্রী: হ্যাঁ। কিছুই করেন না তিনি। খালি বক্তৃতা দেন। তাঁরও পুরো আচরণ হচ্ছে জনসংযোগ করা। করুক, আপত্তি নেই। কিন্তু নিজের কাজটা তো করতে হবে। এক বছর হয়ে গেছে, অথচ এনবিআরের চেয়ারম্যান জানেনই না যে এনবিআর কীভাবে চলে।

প্রথম আলো: বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া টাকাও যে খরচ হয় না…

অর্থমন্ত্রী: পয়সা আছে, কিন্তু খরচ করতে পারছে না—এটাও একটা সমস্যা। অন্য সব মন্ত্রণালয়ের দোষ রয়েছে এতে।

প্রথম আলো: কারণ কী, অদক্ষতা?

অর্থমন্ত্রী: আমার মনে হয়, গত সাত বছরের অর্জন সবাইকে অলস করে তুলেছে। মনোভাবটা এ রকম—আমরা তো ভালোই করছি। অর্থাৎ, মরিয়া ভাবটা আর নেই।

প্রথম আলো: অনেকে বলেন, দেশের বড় বড় প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির পেছনে দুর্নীতি একটা উদ্দেশ্য। আপনি কী মনে করেন?

অর্থমন্ত্রী: প্রথমত, এগুলোর জন্য অভিজ্ঞতা না থাকায় আমরা যথাযথ অনুমানটি (এস্টিমেট) করতে পারি না। সাধারণভাবে অনুমোদন দিয়ে দিই। দ্বিতীয়ত, আমাদের চরিত্রটা দুষ্ট। বড় প্রকল্প মানেই আমরা বড় দাও মারতে চাই।

প্রথম আলো: প্রতিরোধ করা যায় কীভাবে?

অর্থমন্ত্রী: ডিজিটাইজেশন। মুশকিল হচ্ছে, অনেকেরই ডিজিটাইজেশনের প্রতি বিরোধিতা আছে।

প্রথম আলো: রিজার্ভের অর্থ চুরির বিষয়টি নিয়ে সরকারকে যতটা সোচ্চার হতে দেখা গেছে, ব্যাংক খাত থেকে যে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে অতটা সোচ্চার হতে দেখা যায়নি, কেন?

অর্থমন্ত্রী: আসলে অন্য লুটপাট ধরার বিষয়ে কোনো নির্দেশক (ইনডিকেটর) নেই, যার মাধ্যমে তথ্য পেতে পারি।

প্রথম আলো: রিজার্ভ চুরির ঘটনায় যাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো, তাঁদের মধ্যে নির্দোষ কেউ আছেন কি না…

অর্থমন্ত্রী: একমাত্র আসলাম আলম নির্দোষ। ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) হলো। সামান্য শাস্তি, কিন্তু বদনাম তো হলো। আমি আগের দিনই আসলামকে ডেকেছিলাম। বলেছি, তোমার ওপর খড়্গ আছে। কিন্তু তোমার কোনো দোষ নেই।

প্রথম আলো: বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজকর্মে সংস্কার আনার কথা বলছিলেন। কে আনবে সংস্কার?

অর্থমন্ত্রী: নতুন গভর্নরকে ইতিমধ্যে বলেছি, তিনি যাতে একটু সময় নিয়ে হলেও একটা পর্যালোচনা করেন। এরপর উদ্যোগ নেব।

প্রথম আলো: বাংলাদেশ ব্যাংকের নিচতলার কাজগুলো কি আগের মতো সোনালী ব্যাংককে দিয়ে দেওয়া উচিত?

অর্থমন্ত্রী: আমি জানি না। তবে ফরাসউদ্দিন তদন্ত কমিটি এ ব্যাপারেও সুপারিশ করবে বলে আমি আশা করি।

প্রথম আলো: এনবিআরের চেয়ারম্যান কাজকর্ম করছেন না, এ দায় কি আপনারও নয়? আপনারই তো সংস্থা এনবিআর।

অর্থমন্ত্রী: তিনি এত বক্তৃতা দেন যে তাঁকে আসলে তথ্যসচিব বানিয়ে দেওয়া উচিত। সাবেক স্পিকার হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর একান্ত সচিব ছিলেন তো, তাঁরই প্রভাব পড়েছে এনবিআর চেয়ারম্যানের ওপর। আর আমার দায়ের কথা কী বলব। তাঁর সঙ্গে আছেন শক্তিশালী আমলা। আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি, তাঁকে নিয়ে কাজ করা মুশকিল। তিনি রাজনীতিবিদদের সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন।

প্রথম আলো: নতুন গভর্নর সম্পর্কে কিছু বলুন।

অর্থমন্ত্রী: ভালো। তিনি আমার অর্থসচিব ছিলেন। আমি তাঁকে জানি। শিগগির কেন্দ্রীয় ব্যাংক চালানোও তিনি শিখে ফেলবেন।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

অর্থমন্ত্রী: আপনাদেরও ধন্যবাদ।

এবার এই সাক্ষাৎকারের ময়নাতদন্ত করে জিয়া হাসানের দেয়া ফেবু পোষ্টটিও হুবহু টুকে দিচ্ছি-

জিয়া হাসান

অর্থমন্ত্রী আজ প্রথম আলোতে যে সাক্ষাতকার দিয়েছে তার পরে যে কোন সভ্য দেশে তিনি ইম্পিচড হতেন অথবা জেলের ভাত খেতেন অথবা ইনকোইয়ারিতে পরতেন। কিন্ত, এইটা সভ্য দেশ না।

উল্লেখ যোগ্য অংশ যা চোখে পরেছে।

১। “দুজন ডেপুটি গভর্নরের চাকরি গেছে তাঁর কারণে। বোঝাতে চাইলেন যে তিনি একা দায়ী নন। দুজনের বাইরে আরও কয়েকজনের চাকরি খাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তা আর হয়নি, হবেও না।” –


বাংলাদেশ ব্যাংকের গভারনর যিনি এই প্রতিষ্ঠানটা চালিয়েছেন এবং প্রতিষ্ঠানের এবং এই কেলেঙ্কারির ভেতরের খবর জানেন, তিনি আরো কয়েক জনকে অভিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু, অর্থমন্ত্রী সেইটা ঠেকিয়েছেন।
যে কোন সভ্য দেশের তদন্ত , এইটাকে সরাসরি ক্রাইম হিসেবে দেখবে এবং অর্থমন্ত্রীকে বিচার প্রভাবিত করার জন্যে দায়ী করবে।

আরো বোঝা যায়, অর্থমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী চাইলে কারো চাকুরী ঠেকাতে পারেন, বাচাতে পারেন। প্রসেস গুরুত্তপুরন না।

২। “আতিউর রহমান বলার চেষ্টা করেছেন যে বেসিক ব্যাংক, হল-মার্ক কেলেঙ্কারির ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেছিলেন।

অর্থমন্ত্রী: না, না। এগুলো ইতিমধ্যে বহুল আলোচিত বিষয়। বেসিক ব্যাংক পুরোনো বিষয়। বেসিক ব্যাংকের ওপর প্রথম নিরীক্ষা প্রতিবেদনটা ভালো ছিল। তারপর তো বাংলাদেশ ব্যাংকই সব ধামাচাপা দিয়ে দিল।”

অর্থমন্ত্রী এবং শীর্ষ নেতৃত্ব জানেন, বাংলাদেশ ব্যাংক বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতি ধামাচাপা দিয়েছে কিন্ত কোন ব্যবস্থা নেয় নাই। কোন প্রসেস নাই। সিস্টেম নাই। সব ভাই ভাই বিষয়।

৩। “প্রথম আলো: আপনি কিন্তু বলেছিলেন বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন, পরে আর নেননি।

অর্থমন্ত্রী: হ্যাঁ, বলেছিলাম। ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এখনো হয়নি। যাই হোক। রাজনৈতিক ব্যাপার-স্যাপার সব আলাপ করা যায় না।”

আর কোন লজ্জা নাই, শেম নাই, লুকানোর কিছু নাই। রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রশ্রয় থাকলে, হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দিলেও, রাজনৈতিক ব্যাপার বলে ছাড় দিয়ে দেয়া যায়।

৪। “তবে ব্যবস্থা ঠিকই নেওয়া হবে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিষয়টা ঠিকভাবে দেখভাল করতে পারেনি। যখন আদালতে যাবে, আদালত ঠিকই সব জানতে চাইবে এবং তখন ওই লোকটার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা হবে।”

রাজনৈতিক ব্যাপার-স্যাপার সব আলাপ করা যায় না বলার পরেই উপরের লাইনটা বলা হয়েছে। এইটা বাংলাদেশের সরকারের টিপিকাল ডিফেন্স মেকানিজম। অন্যায়ের পরে, দুদককে দিয়ে দায় মুক্তি। একটা কেস করে, সেই কেস অনন্ত কাল ধরে ঝুলিয়ে দিয়ে, বিষয়টা লোক চক্ষুর আড়াল করে দেয়া। ঠিক তাই ঘটেছে বেসিক ব্যাংকের ঘটনায়।

৬। “দুই দিন আগেও তিনি বলেছেন, প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভের কৃতিত্ব তাঁর। রিজার্ভের কৃতিত্ব মূলত প্রবাসী শ্রমিকদের।”

চেতলে মানুষ যখন গালি দেয় তখন সত্যটা বের হয়ে আসে।
আমরা জানতাম, রিজার্ভের ক্রেডিট সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংকের না। আপনার মুখে স্বীকারোক্তি শুনে প্রিত হইলাম।

৭। “প্রথম আলো: রিজার্ভ ভালো বলেই কি আমরা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার সাহস পেলাম?”

কি অথর্ব স্টুপিড প্রশ্ন।

৮। “একবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মিলে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, শেয়ারবাজারে ওভার এক্সপোজার আরও কয়েক বছরের জন্য থাকবে। কিন্তু আতিউর ব্যাংক কোম্পানি আইনে সময়সীমা বেঁধে দিলেন এক বছর। আশ্চর্য কাণ্ড!”

বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেট ক্যালেঙ্কারি নিয়ে, এখনো প্রপার তদন্ত হয় নাই। কিন্তু, মুহিত সাহেবের এই স্বীকারোক্তি ফিউচার কোন তদন্তে হেল্প করবে।
বাংলাদেশের ব্যাংক গুলো শেয়ার মার্কেটে তাদের বাড়তি টাকা বিনিয়োগ করে, নিজেরাই মার্চেন্ট ব্যাংক খুলে ব্যবসা করে শেয়ার মার্কেট বাবলটা সৃষ্টি করেছিল যার বলি হয়েছিল- লক্ষ লক্ষ বিনিয়োগকারি।

এই লাইনে পরিষ্কার স্বীকৃতি আছে- গভারনর সেই ওভার এক্সপজারের ভুল বুঝতে পেরে সেইটা ঠেকাতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু, অর্থমন্ত্রী সেই বাবলকে আর ফুলিয়ে আর বড় ফাদ পেতে রাখতে চেয়েছিল।

আগেও পড়েছিলাম কোথাও, আতিয়ার সাহেব সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই কাজটা করেছিল। এখন কনফারম হলাম। লোকটার প্রতি কোন রেস্পেক্ট নাই। তবুও এই জায়গায় সাহস দেখানোর জন্যে কৃতজ্ঞতা রেখে দিলাম।

৯। “প্রথম আলো: এখনকার চেয়ারম্যান?

অর্থমন্ত্রী: হ্যাঁ। কিছুই করেন না তিনি। খালি বক্তৃতা দেন। তাঁরও পুরো আচরণ হচ্ছে জনসংযোগ করা। করুক, আপত্তি নেই। কিন্তু নিজের কাজটা তো করতে হবে। এক বছর হয়ে গেছে, অথচ এনবিআরের চেয়ারম্যান জানেনই না যে এনবিআর কীভাবে চলে।”

ম্যানেজমেন্টের পরিভাষায় আমরা একে বলি সাইলো। সাইলো গুলো নিজেরা নিজেদের মধ্যে অপারেট করে। কারো কারো সাথে সংযোগ নাই। আর একজন আরেক জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে – কেউ কারো কাছে জবাবদীহি নয়- কার সবার নিজের প্রভু আছে যারা তাকে রক্ষা করে। বাংলাদেশ সরকার যে ঠিক সেই অবস্থায় গ্যাছে, এনবিআরের চেয়ারম্যানকে নিয়ে অর্থমন্ত্রী এই স্বীকারোক্তি তার একটা পরিষ্কার প্রমান।

১০। “প্রথম আলো: রিজার্ভ চুরির ঘটনায় যাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো, তাঁদের মধ্যে নির্দোষ কেউ আছেন কি না…

অর্থমন্ত্রী: একমাত্র আসলাম আলম নির্দোষ। ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) হলো। সামান্য শাস্তি, কিন্তু বদনাম তো হলো। আমি আগের দিনই আসলামকে ডেকেছিলাম। বলেছি, তোমার ওপর খড়্গ আছে। কিন্তু তোমার কোনো দোষ নেই।”

কোন তদন্ত বাদে অর্থমন্ত্রী পরিষ্কার বলে দিচ্ছেন একমাত্র আসলাম আলম নির্দোষ।

বলার কিছু নাই- এইটা ইম্পিচেবল অপরাধ। এবং এই লোকটিকে রক্ষার করার চেষ্টা করার জন্যে, পুলিশ যে কোন সভ্য দেশে অর্থমন্ত্রীকেই তদন্ত করবে। কি তিনি জানেন, যার জন্যে তিনি বলতে পারেন, আসলাম নির্দোষ বাকিরা অপরাধি ?

১১। এবং এখন তিনি একজনকে নিয়োগ দিয়েছে, কেন্দ্রিক ব্যাংকের প্রধান হিসেবে যাকে তিনি জানেন এবং যার যোগ্যতা হচ্ছে

“আমার অর্থসচিব ছিলেন। আমি তাঁকে জানি।” তার অনুগত এবং

“শিগগির কেন্দ্রীয় ব্যাংক চালানোও তিনি শিখে ফেলবেন”।

বি এফ্রেইড, বি ভেরি ভেরি এফ্রিইড। একজন শিক্ষানুবিশকে দেশের কেন্দ্রিয় ব্যাংকের প্রধান করা হয়েছে, যার সিদ্ধান্তের উপরে আপনার এবং আপনার সন্তানের রুটি রুজি নির্ভর করবে।

পুরো সাক্ষাৎকারে আরেকটা জিনিষ চোখে পড়ে সেইটা হইলো, সাবেক গভারনারের প্রতি অর্থমন্ত্রীর ব্যক্তিগত আক্রোশ। সেই আক্রোশটা যদি না থাকতো তবে এই সত্য কথন জাতির সামনে আসতো না।

এই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান গুলোকে কিভাবে ভেঙ্গে টুকরো করে ফেলা হয়েছে তার জন্যে এই সাক্ষাতকারের চেয়ে বড় কোন প্রমান লাগেনা।

উপরিউক্ত সাক্ষাৎকারটি প্রথম আলোয় প্রকাশিত হলে অর্থমন্ত্রী বেকায়দায় ফেঁসে যান। ফলে তিনি ১৯ মার্চ সংবাদপত্রে ‘প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য মনে করিনা’ শীর্ষক একটি প্রতিবাদলিপি পাঠান। সেটি, এবং এই বিষয়ে প্রথম আলোর ভাষ্য টুকে রাখার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না-

প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় গতকাল প্রকাশিত ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তারা জড়িত’ শীর্ষক সাক্ষাৎকারের বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
গতকাল শুক্রবার সম্পাদক বরাবর পাঠানো লিখিত চিঠিতে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘অতীব দুঃখের সঙ্গে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, আপনার সংবাদপত্রে আজকে প্রকাশিত আমার সাক্ষাৎকারের বক্তব্য আমি একেবারেই গ্রহণযোগ্য মনে করি না। সচরাচর আমার সাক্ষাৎকার যাঁরা নেন তাঁরা জানেন যে, সেই সাক্ষাৎকারের খসড়া আমি দেখে দিই এবং আমার অনুমোদন ব্যতিরেকে তা কখনো প্রকাশিত হয় না।
সর্বজনাব সোহরাব হাসান ও ফখরুল ইসলাম ১৭ মার্চ আমার সঙ্গে অনেকক্ষণ বসে একটি সাক্ষাৎকার নেন। সেখানে সাক্ষাৎকারের বাইরেও নানা বিষয় আলোচিত হয় এবং অনেক বিষয়ে আমি সাবধান করে দেই যে, তা প্রকাশিতব্য নয়। সচরাচর আমার পূর্ব নির্ধারিত কোনো সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হলে তার খসড়াটি সাক্ষাৎকারীরা আমাকে দেখে দিতে প্রদান করেন এবং আমার সম্পাদিত সাক্ষাৎকারই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এই সাক্ষাৎকারে সেই রুটিন প্রতিপালিত হয়নি। এই সাক্ষাৎকারে বিশেষ করে প্রতিভাত হলো যে, বয়সের চাপে আমি এখন সদা সতর্ক থাকতে পারি না।
আপনার কাছে বিনীত অনুরোধ যে, কালকের কাগজে প্রথম পৃষ্ঠায় বড় হরফে জানিয়ে দেবেন যে, এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা আমার চূড়ান্ত অনুমোদন ছাড়া হয়েছে এবং এর বক্তব্য আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।’


প্রথম আলোর বক্তব্য

গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি দেওয়ার জন্য আমরা মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। সাক্ষাৎকারটি প্রকাশের উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির পর অর্থমন্ত্রী তথা সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ এবং ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সার্বিক বিষয়ে পাঠককে জানানো। সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় তিনি যেসব বিষয়ে ‘অফ দ্য রেকর্ড’ কথা বলেছেন কিংবা যেসব বিষয় প্রকাশ করতে নিষেধ করেছেন, সেসব বিষয় আমরা প্রকাশ করিনি।
গত ২১ মাসে দেশের ভেতরে ও বাইরে নেওয়া মাননীয় অর্থমন্ত্রীর পাঁচটি সাক্ষাৎকার প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছে। সেসব সাক্ষাৎকার প্রকাশের আগে তাঁকে খসড়া দেখিয়ে নেওয়ার প্রসঙ্গ ওঠেনি। গত বৃহস্পতিবার সাক্ষাৎকার নেওয়ার পরও খসড়া দেখানোর বিষয়টি আলোচিত হয়নি। তবে অর্থমন্ত্রীর পাঠানো ব্যাখ্যা আজ হুবহু প্রকাশ করা হলো।
জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিত বহু বছর ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, কূটনীতিক এবং লেখক। তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা আছে এবং তা সব সময় অটুট থাকবে।
—বার্তা সম্পাদক

শাসনতান্ত্রিক সংস্কার বিষয়ে বেগম জিয়ার ওয়াদা- বাস্তবতা ও করণীয়

পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিলো ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী, বেগম খালেদা জিয়া, সরকার গঠন করেছিলেন প্রায় তেইশ দিন পর ২০ মার্চ। অন্যদিকে এরশাদের পতনের প্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের পদে আসা বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদ পুনরায় প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে যান অক্টোবরের ১০ তারিখ।

সাধারণত নির্বাচনের পর সরকার গঠনে প্রায় এক মাস দেরি হয়না, মেয়াদ পূর্তির বিষয় না থাকলে নয়া রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনেও সাধারণত প্রায় সাড়ে সাত মাসের দেরি হয়না। অবশ্য সে নির্বাচনে বিএনপি ১৪০ আসনে জয়ী হওয়ায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য আরো ১১ জন সাংসদের সমর্থন যোগাতে হয়েছিলো। এজন্য সরকার গড়তে কিছুটা দেরি হলেও মূল যে কারণে এসব বিলম্ব ঘটে তা হচ্ছে, সরকার পদ্ধতি সম্পর্কে ফয়সালায় জটিলতা।

বিএনপি প্রেসিডেন্ট পদ্ধতিতেই থেকে যেতে চাচ্ছিলো। কিন্তু আওয়ামী লীগের দাবী ছিলো সংসদীয় গণতন্ত্র তথা প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকারের। অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট নিজেও সংসদীয় সরকারের পক্ষে ছিলেন। তিনিই ছিলেন নির্বাহী ক্ষমতাধর। অথচ বেগম জিয়া প্রধানমন্ত্রী হবার পর তিনি মন্ত্রীসভা বৈঠকে সভাপতিত্ব করা থেকেও নিজেকে গুটিয়ে নেন। এমনকি শেষে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে, সরকার পদ্ধতি সম্পর্কে জলদি সিদ্ধান্ত না নিলে তাঁকে মাফ করা হোক, মর্মে পদত্যাগের হুমকি দিলে বিএনপি সংসদীয় সরকারের পক্ষে সমর্থন দেয়। শাহাবুদ্দীন আহমদের এই পদক্ষেপের জন্য আওয়ামী লীগের ধারণা হয় যে, তিনি ‘তাদের লোক’। আর এই ধারণা থেকেই ১৯৯৬ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে শাহাবুদ্দীন আহমদকেই প্রেসিডেন্ট করেন হাসিনা ওয়াজেদ।

যাহোক, শেষবার ক্ষমতাসীন হয়েও বিএনপি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ও প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির শাসনব্যবস্থায় ফিরে যেতে উদ্যোগী হয়। তখন প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন সালাহউদ্দীন কাদের চৌধুরী। তাকে এই ব্যাপারে বেশ সক্রিয় হতে দেখা গেলেও পরে অদৃশ্য কারণে সমস্ত উদ্যোগ থেকে বিএনপি নিজেকে সংবরণ করে।

আজ ১৯ মার্চ ২০১৬ তারিখে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনে আয়োজিত বিএনপির ষষ্ঠ কাউন্সিল অধিবেশনে লিখিত বক্তব্য পাঠের সময় বেগম খালেদা জিয়া প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের স্বার্থে ভবিষ্যতে ক্ষমতাসীন হলে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে সংসদে উচ্চকক্ষ স্থাপনের কথা বলেছেন। এছাড়াও তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিপুল ক্ষমতা হ্রাসের ইঙ্গিতও দিয়েছেন।

এই প্রস্তাবে আমি আশাবাদী নই। প্রধানমন্ত্রীর নিকট নজিরবিহীন ক্ষমতা এনেছিলো বিএনপিই, ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট শাসনতন্ত্রের দ্বাদশ সংশোধনী প্রস্তুতের সময়। আর ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ বলতে যা বুঝায়, তা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের চেয়ে ফেডারেল রাষ্ট্রীয় কাঠামোই অধিক নিশ্চিত করে। তাছাড়া যদি উচ্চকক্ষকে ক্ষমতার দিক থেকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে বসানো হয়, তবে দেশের কিছু টাকার অপচয় ছাড়া আর কিছু হবে না।

প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোই হোক, অথবা দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভাই হোক, এসব বিরাট প্রশাসনিক সংস্কারের বিষয়, যার আনজাম দেয়ার মতো বিপ্লবী শক্তি বর্তমানে বিএনপি বা আওয়ামী লীগের আছে বলে আমি মনে করি না।

আমি আগেই বলেছি, এধরণের উদ্যোগ কোন আনকোরা ও বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক শক্তির পক্ষেই ফলপ্রসুভাবে নেয়া সম্ভব, যারা শুধু সিদ্ধান্ত গ্রহণেই নয়, তা চাপিয়ে দিতেও বেধড়ক শক্তি আর নৈতিক বৈধতা ধারণ করবে। অতীতে এরচেয়ে ঢের অনুকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যা বিএনপি করতে পারেনি, তা বর্তমানে বহুদা বিভক্ত ও অপেক্ষাকৃত ঘোলাটে রাজনৈতিক অবস্থায় তারা আরো পারবে না; এমনকি যদি ধরেও নেই যে, অচিরেই এরা ক্ষমতাসীন হতে যাচ্ছে!

অধিকিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে ইসলামের বিশেষ মর্যাদাসমূহ তুলে দেয়ার যেসব ঘটনা ঘটেছে, অথবা ভবিষ্যতে ঘটবে, তাও বিএনপি ক্ষমতায় এলে নির্দ্বিধায় ও বিনা বাক্যব্যয়ে পুনর্বহাল করার মতো শক্তি রাখেনা। বিগত দিনগুলোতে সংবিধান নিয়ে যেসব কাণ্ড ঘটেছে, সংবিধানের কিছু বিধানকে যেভাবে দুষ্পরিবর্তনীয় করা হয়েছে, তাতে নিছক আরেকটি সংশোধনী এনে কতোটা ফলপ্রসূ সমাধান সম্ভব তা আমার জানা নেই। বরং ভবিষ্যতে একটি সাংবিধানিক গণপরিষদ গঠন করে নতুনের পথে অগ্রযাত্রায় আনকোরা শাসনতন্ত্র সহ বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের যাত্রা শুরু করাই হবে সময়োপযোগী।

যাহোক, এটা অনস্বীকার্য যে, সরকার ও আইনসভার কাঠামোগত সংস্কার এখন সময়ের দাবী। সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, পেশাজীবী, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক, বেসামরিক আমলাদের নিয়ে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠিত হতে পারে। তবে অবশ্যই, উচ্চকক্ষকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। যার মধ্যে আছে ক্ষেত্রবিশেষে নিম্নকক্ষে গৃহীত কোন আইনে ভেটো প্রয়োগ করা। একটি ক্ষমতাশালী উচ্চকক্ষ বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে পারে। এর দ্বারা দলীয় নেত্রীদের উপদেষ্টা হয়ে পর্দার আড়ালে শুভ-অশুভ কর্মতৎপরতায় জড়ানোর চেয়ে প্রকাশ্য নীতিনির্ধারণে ভূমিকা পালন করতে পারবে দেশের বুদ্ধিজীবী ও সুশীল মহল। উদাহরণস্বরূপ, কামাল হোসেন, এমাজউদ্দীন আহমদ, তালুকদার মনিরুজ্জামান, রেহমান সোবহান প্রমুখের মতো ব্যক্তিরা ভোটের রাজনীতিতে অচল। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে এদের মতো ব্যক্তির অতীব প্রয়োজন। একটি শক্তিশালী উচ্চকক্ষ ও তাতে গুণী ব্যক্তিদের সমাবেশ এভাবে দেশের উপকার করতে পারে।

কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি যদি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা কায়েমও করে, তারা কি উচ্চকক্ষে অর্থবহ ক্ষমতা দেবে, নাকি তাকে আলংকারিক ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে রাখবে? অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়।

প্রধানমন্ত্রীকে ভারসাম্যহীন ক্ষমতায় ভূষিত করার পেছনেও বিএনপির ভূমিকাই প্রধান। সেসময়ের প্রধান বিরোধীদল আওয়ামী লীগ সঙ্গত কারণেই এর বিরোধিতা করেনি। আমার মতে, প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার ক্ষেত্রে ১৯৫৬ সালে প্রণীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানের মডেল সবচেয়ে উপযুক্ত। সেই সংবিধানের অন্যতম রচয়িতা ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মোহাম্মদ আলী বগুড়া। সেই সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর হাতে নির্বাহী ক্ষমতা অর্পণ করার পরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির নিকট দেয়া হয়েছিলো। তবে পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটে ১৯৫৬ সংবিধান ব্যর্থ হয়েছিলো। তার কারণ ছিল দেশটির বিচিত্র ভৌগলিক আকৃতি ও জাতিতাত্ত্বিক বিভিন্নতা। কিন্তু বাংলাদেশের মতো এক রঙ্গা দেশে একজন শক্তিশালী রাষ্ট্রপতির অধীনে নির্বাহী ক্ষমতাধর প্রধানমন্ত্রী থাকার পদ্ধতি কাজে দেবে বলেই আমার ধারণা। অন্তত এতে করে দেশে নতুন করে ব্যক্তিবিশেষের স্বৈরতন্ত্র জেঁকে বসা মুশকিল হবে।

আমার মতে রাষ্ট্রপতির নিকট বিচারবিভাগ, সাংবিধানিক সংস্থাসমূহের পূর্ণ বাগডোর দেয়া উচিত। সাথে সাথে আর্থিক সংকটের সময় ভিন্ন উৎস থেকে অর্থ মঞ্জুর করা, এবং আইনসভায় প্রণীত কোন আইনের ব্যাপারে নিজের আপত্তি জানিয়ে তা ফেরত পাঠানো, এবং ক্ষেত্রবিশেষে বাতিল করার অধিকার দেয়া যেতে পারে। আর এধরণের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচন হতে হবে গোপন ব্যালটে। এর ভোটার হবেন সাংসদ থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের মহিলা মেম্বার পর্যন্ত সকল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি।

কিন্তু এমন কোন সাংবিধানিক সংস্কার বিএনপি আনবে না, যার দ্বারা ক্ষমতায় থাকাকালীন তাদের নেতার সাংবিধানিক ক্ষমতা খর্ব বা নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে বিএনপির এই ওয়াদা হয় ওয়াদার মধ্যেই থেকে যাবে, নয়তো পর্বত মূষিক প্রসব করবে…।

অধ্যাপক ইউসুফ আলী ও মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং থমাস জেফারসনের দীর্ঘশ্বাস

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী। তিনি ছিলেন ছিলেন প্রবাসী সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী। স্বাধীনতার পর শুধু তিনি দেশের প্রথম শিক্ষামন্ত্রীই ছিলেন না, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করা ইউসুফ আলীই ছিলেন বিসিবির প্রথম সভাপতি।
AliProfessorMohammadYusuf
অধ্যাপক ইউসুফ আলী (অনুমিত) [১৯২৩-১৯৯৯]
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী বাকশাল গঠিত হলে তিনি এর অন্যতম অঙ্গসংগঠন জাতীয় শ্রমিক লীগের সম্পাদক হন (অর্থাৎ প্রধান)। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি খন্দকার মুশতাক আহমদের সরকারে পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরে সেই সরকারের অর্থমন্ত্রী আজিজুর রহমান মল্লিকের অনুপস্থিতিতে কিছুদিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও পালন করেন।
১৯৭৮ সালে বাকশাল সঠিক ছিল, নাকি ভুল ছিল সেই প্রশ্নে বাহাসে লিপ্ত হয়ে আওয়ামী লীগ ভেঙ্গে যায়। ডাকসাইটে আওয়ামী লীগ নেতা চাঁদপুরের মিজানুর রহমান চৌধুরী নোয়াখালীর আবদুল মালেক উকিলের মূল আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে বাকশাল বিরোধী নতুন আওয়ামী লীগ গঠন করেন, ইউসুফ আলী ছিলেন যার সাধারণ সম্পাদক। ১৯৭৯ সালে অধ্যাপক ইউসুফ আলী বিএনপিতে যোগ দেন, এবং প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমানের মন্ত্রীসভায় শামিল হন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সেসময় নিজের দলের মহাসচিব করলেও দীর্ঘদিন পর মিজানুর রহমান চৌধুরী তার রাজনৈতিক আত্মজীবনী ‘রাজনীতির তিনকাল’ বইতে লিখেছেন, ১৯৭১ সালে নাকি ইউসুফ আলীর বদলে তারই স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠের কথা ছিল। অত্যন্ত সুবক্তা হিসেবে খ্যাত মিজানুর রহমান চৌধুরী আইয়ুব খানের আমলে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন।
পরবর্তীতে ছয়দফা আন্দোলনের উত্তপ্ত সময়ে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে চমৎকার ভূমিকা পালন করে জাতীয় রাজনীতির পুরোভাগে মিজানুর রহমান চৌধুরী। স্বাধীনতার পর প্রথমে ত্রাণ ও পরে তথ্য মন্ত্রণালয় সামলান তিনি। তথ্যমন্ত্রী থাকাকালীন এক বিশ্রী ঘটনায় তার মুখ কালো হয়, যার ফলে বঙ্গবন্ধু তৎক্ষণাৎ তাকে ইস্তিফা দিতে বলেন। বঙ্গবন্ধুর বাকি সময়ে তিনি আওয়ামী লীগেও ব্রাত্য হয়ে পড়েন। তবে তিনি দাবী করেন জেনারেল ওসমানী ও ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনের মতো তিনিও বাকশালের বিরোধিতা করে বঙ্গবন্ধুর বিরাগভাজন হন।
যাহোক, জিয়াউর রহমানের সাথে না গেলেও পরবর্তীতে তিনি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সাথে ভিড়ে যান। তিনি এরশাদের প্রাথমিক রাজনৈতিক ফ্রন্ট জনদলের সভাপতিত্বও করেন। সরকারে তাকে প্রথমে ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৮৬ সালের ৯ জুলাই প্রেসিডেন্ট এরশাদ মিজানুর রহমান চৌধুরীকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। বাংলাদেশের ষষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি ১৯৮৮ সালের ২৭ মার্চ পর্যন্ত নিয়োজিত ছিলেন। এরশাদের পতনের পর ১৯৯৬ সালে মুক্তির আগ পর্যন্ত মিজানুর রহমান চৌধুরী জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। মিজান চৌধুরীর বইতে পাওয়া যায়, এই সময়ে এরশাদ নাকি জেল থেকে তাকে বিভিন্ন বিশেষণে (কাণ্ডারি, বাবা) চিঠি লিখতেন। এরপর তিনি জাতীয় পার্টি ভেঙ্গে বর্তমান পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে মহাসচিব করে নতুন জাতীয় পার্টি গঠন করেন। মঞ্জু এখন জাতীয় পার্টির সেই ভগ্নাংশেরই চেয়ারম্যান।
২০০১ সালে দীর্ঘ রাজনৈতিক পরিভ্রমণ শেষে তিনি আওয়ামী লীগে ফেরত আসেন দলটির উপদেষ্টা পরিষদের সভ্য হিসেবে। প্রবীণ রাজনীতিবিদ হিসেবে আতাউর রহমান খানের মতো তারও বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হবার ইচ্ছা ছিল। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে তাকে প্রেসিডেন্ট হবার প্রস্তাব দেয়া হয় বলে তিনি দাবী করেছেন। আওয়ামী লীগে ফেরার পরও তিনি ভবিষ্যতে দল থেকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন লাভের প্রত্যাশা করেন, যা তিনি নিজেই এটিএনে এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন। তবে ২০০৬ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়েই মিজানুর রহমান চৌধুরীর মৃত্যু হয়।
ফলে দেখা যাচ্ছে, ইউসুফ আলীর বদলে মিজানুর রহমান চৌধুরী স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করলেও তা আলাদা কোন ঐতিহাসিক সুষমা লাভ করতো না।
file
মিজানুর রহমান চৌধুরী (১৯২৮-২০০৬)
হায় চেতনা! যাদের থমাস জেফারসন হবার কথা, তারা শেষমেশ ‘টোকাই রাজনীতিবিদ’ (মিজান চৌধুরী নিজেই ডিগবাজী দেয়া রাজনীতিবিদদের টোকাই রাজনীতিবিদ বলে উল্লেখ করেছেন) হয়ে পড়েছিলেন! ইতিহাস বড় নির্মম। আর এই জন্যই হয়তো বাংলাদেশের প্রথম সরকার কতৃক ঘোষিত স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠকারী ঐতিহাসিক এই ব্যক্তিত্বের ছবি গুগলে পেলাম না! যে ছবিটা ইউসুফ আলীর নামে পেলাম, তা আদৌ তার ছবি কিনা সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই। তবে এসব তথ্য চেতনা ব্যবসায় কোন প্রভাব ফেলেনা। যদি এসবে প্রভাবিত লোকজন এতোই ভালো হতো, তাহলে তো আর সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ ‘লালসালু’ লিখে কালোত্তীর্ণ হতেন না…!

জিয়াউর রহমান সম্পর্কে সিপিবির বুনিয়াদী অবস্থান ও আমার বিবেচনা

জিয়াউর রহমান সম্পর্কে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি তথা সিপিবির মূল্যায়ন কি? একেবারে সাধারণ ধারণা থেকেও কেউ এক নিঃশ্বাসে বলে যাবে, সিপিবি জিয়ার শাসনামলকে কালো অধ্যায় মনে করে। সার্বিকভাবে জিয়াউর রহমান সম্পর্কে সিপিবির মূল্যায়ন অবশ্যই নেতিবাচক ও অগ্রাহ্যসূচক হবার কথা। কিন্তু আসলেই কি তাই? জিয়া যখন রাজনীতি শুরু করেন, তখন তিনি মাওবাদী কমিউনিস্টদের সমর্থন পেয়েছিলেন। কিন্তু সেসময় মার্ক্সবাদীদের অবস্থান কি ছিল তা সেভাবে পাদপ্রদীপের নিচে আসেনা। এদেশের মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট রাজনীতির প্রধানতম সংস্থা সিপিবির জিয়াউর রহমান সম্পর্কে মূল্যায়ন দেখলে চমকে যেতে হয়।
সম্প্রতি প্রকাশিত ‘বিএনপিঃ সময়-অসময়’ বইতে এই বিষয়ে এমন একটা তথ্য পেলাম, যা আমাকে চমৎকৃত করেছে। সিপিবি সেসময় কেবল জিয়াউর রহমানের গৃহীত কর্মসূচীগুলোকেই সমর্থন করেননি, এমনকি ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে আরেক কমিউনিস্ট সংগঠন জাসদ ও তার আইকনিক ফিগার আবু তাহেরকে পরাস্ত করে যেভাবে ক্ষমতা সংহত করেছিলেন, তার প্রতিও সমর্থন সূচক মূল্যায়ন ব্যক্ত করে। এই বিষয়ে সিপিবি নেতৃত্বের মূল্যায়ন ছিল, ‘জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নেয়ায় স্বাধীনতা নস্যাৎ হবার, তথা চরম প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীগুলোর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার বিপদ হ্রাস পেয়েছে।’ এখানে সিপিবি যাদের ‘চরম প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী’ হিসেবে প্রতিপন্ন করছে, তারা আর কেউ নয়, জাসদ ও তার সামরিক শাখা গণবাহিনী।
এই বইতেই জাসদের ছাত্র সংগঠন জাসদ ছাত্রলীগের এক কর্মী কামালউদ্দীন আহমেদের জবানীতে সিপিবি ও তার প্রধান নেতা মণি সিংহের কথা উঠে এসেছে এভাবে-
“সামরিক আইন অমান্য করার অভিযোগে আমি তখন ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের ‘বিশ’ সেলে। এটা ১৯৭৭ সালের ঘটনা। ‘বিশ’ সেলে তখন মণি সিংহসহ সিপিবির আরও কয়েকজন নেতা বন্দী ছিলেন। একদিন মণি সিংহ আমাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, ‘তোমার হাতের লেখা ভালো, একটা চিঠি ড্রাফ্‌ট করে দিতে হবে।’ উনি ডিক্টেশন দিলেন, আমি লিখলাম। জিয়াকে উদ্দেশ্য করে একটা চিঠি। বিষয়বস্তু ছিল, আমরা আপনার উনিশ দফা সমর্থন করি। তাহলে আমরা জেলে কেন ইত্যাদি। কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁরা ছাড়া পেয়ে যান, এবং জিয়ার খালকাটা কর্মসূচীতে যোগ দেন।”
দেখা যাচ্ছে, এরা কেবল সমর্থনই করেননি, জিয়ার কর্মসূচীতে যোগও দিয়েছিলেন!
শুধু তাই নয়, বইটিতে পড়লাম, ক্ষমতার শীর্ষে জিয়াউর রহমানের আরোহণকে সিপিবির কেন্দ্রীয় সমিতি ‘পরিবর্তনের সূচনা’ হিসেবেই দেখেছিলো। ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারীতে এই বিষয়ে সিপিবির মূল্যায়নে বলা হয়-
“… আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী গোষ্ঠীগুলো জাতীয় স্বাধীনতার সুফলসমূহ, রাষ্ট্রীয় চার নীতি, জাতীয়করণ, জোট-নিরপেক্ষ প্রগতিশীল বৈদেশিক নীতি সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়ে জাতীয় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতা নস্যাৎ এবং পুনরায় পাকিস্তানী আমলের মতো অবাধ পুঁজিবাদী শোষণ কায়েমের জন্য যেভাবে তৎপর হয়েছিলো, তা কতক পরিমাণে প্রতিহত হয়েছে। দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়া এবং স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী গোষ্ঠীগুলো বর্তমানে কিছুটা কোণঠাসা হয়েছে।”
‘বিএনপিঃ সময়-অসময়’ বইয়ের লেখক মহিউদ্দিন আহমদের বিশ্লেষণে সিপিবির এই মূল্যায়ন খন্দকার মুশতাক আহমদের তুলনায় জিয়াউর রহমানকে অধিক গ্রহণযোগ্যতা প্রদান করে এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতার প্রশ্নে জিয়ার ভূমিকাকে অধিকতর ইতিবাচক দ্যোতনা প্রদান করে।
সিপিবির ব্যাপারে কিছু লেখার আগে আমি পুরো বিষয়টি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবো। সোজা কথায় শীতল যুদ্ধের দিনগুলোতে প্রায় প্রতিটি তৃতীয় বিশ্বের দেশেই মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর মূল সংগঠন প্রকারান্তরে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক মুখপাত্র হিসেবে কাজ করতো। সেক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, জিয়ার প্রতি সিপিবির প্রায় প্রকাশ্য সমর্থন প্রমাণ করছে, জিয়াউর রহমান কূটনৈতিক দিক থেকে ততদিনে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ইতিবাচন যোগাযোগ স্থাপনে সমর্থ হয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে ১৯৭৭ সালের মাঝামাঝিতে ঢাকায় সংঘটিত বিমান সেনা বিদ্রোহের পেছনের কারিগর কে সে ব্যাপারে নতুন করে ভাবতে হয়। আমার ধারণা ছিল, এটা কেজিবির কাজ। তবে এখন মনে হচ্ছে, কেজিবি নয়, অন্য কেউ এর পেছনে ছিল। অবশ্য কেজিবিও থাকতে পারে। কারণ উপরে উপরে সৌহার্দের ভান করে তলে তলে অন্তর্ঘাতমূলক অভিযান চালনা করা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার একটি পুরানো কৌশল।
উপরে উক্ত ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারীতে জিয়াউর রহমান সম্পর্কে সিপিবির পলিটব্যুরোর মূল্যায়নে একটি ভিন্ন দিকের আঁচ আমি পাচ্ছি। এমনিতেই এই মন্তব্য প্রথম দৃষ্টিতে পুরোপুরি দুর্বোধ্য ও বিভ্রান্তিকর বলে মনে হয়। কারণ সেই মন্তব্যে যে পরিস্থিতি উত্তরণে জিয়ার ভূমিকার প্রশংসা করা হয়েছে, আজকাল সেগুলোর জন্যই একমাত্র জিয়াকে দায়ী করা হয়। সিপিবির লোকেরাও জিয়াকেই দায়ী করে। তাহলে ১৯৭৭ সাল নাগাদ জিয়া কাদের দমন করেছিলেন, যারা ইতোপূর্বে জাতীয় নীতি, জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন, বা পাকিস্তান আমলের মতো অবাধ পুঁজিবাদের বিস্তার ঘটিয়েছিল? ১৯৭৭ সালের আগে এসব করতে সক্ষম যদি কেউ হয়েই থাকে তাহলে তা তো আওয়ামী লীগ! কিন্তু আওয়ামী লীগকে তো এখন জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি, জাতীয়করণ আর পুঁজিবাদ বিরোধী অর্থনীতি কায়েমের জন্য সংবর্ধিত করা হয়!
ফলে সিপিবির এই মূল্যায়নকে নতুন দৃষ্টিতে দেখতে হবে। আমি মনে করিনা, ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারীতে দেয়া সিপিবির সেই মূল্যায়নে সামঞ্জস্যের অভাব ছিল। বরং তারা খুব সম্ভবত ১৯৭৪ সালের পর শেখ মুজিবুর রহমানের নীতিতে আসা বিবর্তনের দিকেই ইঙ্গিত করে এসব কথা বলেছিল। এটা অনেকের কাছেই শোনা যে, মুজিব ১৯৭৪ সাল থেকে ক্রমেই রুশ-ভারত অক্ষ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া শুরু করছিলেন। এর লক্ষণ হিসেবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে এদেশে উষ্ণ অভ্যর্থনা প্রদান, বাংলাদেশের ওআইসিতে যোগদান ইত্যাদির কথা বলা যায়। সেসময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন ও কিছু বামপন্থী আওয়ামী লীগার, সর্বোপরি, ভারতের ভ্রুকুঞ্চন উপেক্ষা করে শেখ মুজিব লাহোর সফর করেন। এমনকি তাঁকে নিবৃত্ত করার শেষ চেষ্টা হিসেবে অন্তত দিল্লী হয়ে লাহোর সফর করার প্রস্তাব দেয়া হলেও তিনি অত্যন্ত ক্ষোভের সাথে সেই পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করেন।

মুজিব হত্যায় আমেরিকার ভূমিকার বিষয়ে আলোকপাত করে প্রথম আলোর সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানের লেখা বইতে দেখা যায়, ১৯৭৫ সালের জানুয়ারীতে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত হোসেন আলী মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে বৈঠক করে বলেছিলেন, বাংলাদেশ পাকিস্তানের সাথে নিঃশর্ত আলোচনার ভিত্তিতে সম্পর্ক উন্নয়ন চায়, যার মধ্যস্থতাকারী হতে পারে আমেরিকা। হোসেন আলী নাকি ঢাকা থেকে আদিষ্ট হয়েই এই বিষয়ে কথা বলতে স্টেট ডিপার্টমেন্টে যান।

অধিকিন্তু, বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর যেসব অর্থনৈতিক সংস্কারের কথা ভাবা হচ্ছিলো, তার মধ্যে ক্রমান্বয়ে বেসরকারীকরণ উৎসাহিত করা অন্যতম ছিলো। শেখ মুজিবুর রহমানের নীতির এহেন বিবর্তন বিষয়ে এখন ইচ্ছা করেই মুখ বন্ধ রাখা হয়।

মজার বিষয় হচ্ছে, সিপিবির নেতারা এখন পারতপক্ষে অস্বীকার করবেন যে তারা একদা জিয়াউর রহমানকে সমর্থন দিয়েছিলেন, এই কারণে যে তিনি বাংলাদেশে ডানপন্থার বিকাশে একটি প্রাচীরের কাজ করছেন। আমরা অহেতুক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বা মওদুদ আহমদের দোষ দেই। আসলে রাজনীতিবিদ মাত্রই ডিগবাজী পটীয়সী হতে হয়। সকলেই ডিগবাজী মারে, দোষ হয় এরশাদ আর মওদুদের…!

বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যকার ক্ষমতার ভারসাম্য আনার ব্যাপারে একটি প্রস্তাবনা

১৯৫৬ সালে পাকিস্তানে প্রণীত প্রথম সংবিধানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনায়নের চেষ্টা করা হয়েছিলো। ফলে শাসনতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাহী ক্ষমতাধর ও জাতির নেতা হিসেবে তুলে ধরা হলেও রাষ্ট্রপতিকে রাষ্ট্রের মূল অভিভাবকত্ব দেয়ার নামে আদতে মূল ক্ষমতাশালী করা হয়েছিলো। বৈচিত্র্যময় জাতিগোষ্ঠী ও ভূখণ্ডের পাকিস্তানকে একসাথে রাখতে একনায়কতন্ত্র কোন সমাধান নয়, এমন ধারণার বশবর্তী হয়েই রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনা হয়েছিলো।

কিন্তু উদ্দেশ্য ভালো হলেও পাকিস্তানের শাসনযন্ত্রে চেপে বসা কুচক্রীদের চক্রান্তে এই ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়। প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাহী ক্ষমতাধর করা হলেও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার কাছে তাকে অসহায় থাকতে হয়। ফলে দুই বছরের মধ্যেই শাসনযন্ত্র ভেঙ্গে পড়ে। ক্ষমতা দখল করেন প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইয়ুব খান। এই দুই বছরে মীরজাফরের বংশজাত ইস্কান্দার মীর্জা প্রেসিডেন্ট হিসেবে বহাল থাকলেও মূলত এই ব্যক্তির কুচক্রে চারবার প্রধানমন্ত্রীত্ব বদল হয় চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ইসমাইল ইবরাহীম চুন্দ্রীগড় ও ফিরোজ খান নূনের মধ্যে।

১৯৯১ সালে প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকার ব্যবস্থার বদলে বাংলাদেশে যে শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়, তাতে প্রধানমন্ত্রীকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রদান করা হয়। এমনকি সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশের নির্বাহী ক্ষমতা মন্ত্রীসভার নিকট নয়, বরং প্রধানমন্ত্রীর নিকট ন্যস্ত। এটা পুরো শাসনব্যবস্থাকে প্রকারান্তরে অর্থহীন করে ফেলেছে। কিছুদিন পরপরই সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধির দাবী ওঠে।

গত বছর আয়োজিত এমন একটি সভার কথা বলতে পারি। পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট নামের এক বেসরকারী সংস্থা কতৃক আয়োজিত এক সেমিনারে বলা চলে বাংলাদেশের সুশীল সমাজের সব রুইকাতলারা জড়ো হয়ে টেকসই নির্বাচন ব্যবস্থার স্বার্থে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধির দাবী করেছিলেন। দাবী পেশকারীদের নামগুলো বেশ ভারী- অধ্যাপক রেহমান সোবহান, আকবর আলী খান, রওনক জাহান, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইনাম আহমেদ চৌধুরী, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের এককালীন অর্থমন্ত্রী এম সাঈদুজ্জামান, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আতাউর রহমান, সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। এমনকি পৃথকভাবে ফজলে হাসান আবেদের মতো ব্যক্তিও অভিন্ন দাবী করেছেন।

বস্তুত, একসাথে বড়বড় রুই-কাতলাদের অভিন্ন দাবীর মানে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধির দাবী উঠতে যাচ্ছে বেশ জোরেশোরেই। যদিও উপরিউক্ত প্রায় সকলের গায়েই পশ্চিমের নৈকট্যের প্রকাশ্য ছাপ্পড় মারা, তারপরও আমি নীতিগতভাবে ১৯৫৬ সালের শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রণীত শাসনতন্ত্রের আদলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় যৌক্তিক ভারসাম্য আনায়নের পক্ষপাতী। কারণ ভৌগলিকভাবে দ্বিখণ্ডিত সাবেক পাকিস্তানের জন্য এই ফর্মুলা যতোটা অনুপযুক্ত বলে বিবেচিত হয়েছিলো, প্রায় সকল দিক থেকে ঐক্যবদ্ধ চরিত্রের বাংলাদেশে এই ফর্মুলা ততোটাই উপযুক্ত হবে বলে আমার ধারণা। এতে সরকারে কোন্দল লাগার সম্ভাবনা থাকলেও আর যাই হোক স্বৈরতন্ত্র জেঁকে বসার সুযোগ পাবেনা। অধিকিন্তু, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় ভারসাম্য থাকায় বিগত প্রায় আড়াই দশক যাবত চলে আসা পরিবারতন্ত্রও আপন জৌলুশ হারাতে পারে (যদিও বর্তমানের দুই রাজপরিবারের নিকট ভবিষ্যৎ এখনই হুমকির মুখে)।

আমার মতে রাষ্ট্রপতির হাতে প্রাথমিকভাবে নিম্নবর্ণিত ক্ষমতা দেয়া উচিত –
* সকল সাংবিধানিক সংস্থার প্রধান ও বাকি সভ্য নিয়োগের পূর্ণ অধিকার,
* জাতীয় সংসদে উত্থাপিত কোন বিলে সংশোধনীর সুপারিশ ও প্রয়োজনে ভেটো প্রয়োগের অধিকার,
* সংসদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেকোনো সাংবিধানিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিল বা প্রস্তাব সার্বজনীন গণভোটে দেয়ার স্বেচ্ছাধীন         অধিকার,
* সংসদ ও আইন মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে বিচার বিভাগের কতৃত্ব তুলে নিয়ে তা রাষ্ট্রপতির একচ্ছত্র অনুকূলে                     বিচারবিভাগের জন্য নিয়োজিত একটি আলাদা সচিবালয়ের কাছে ন্যস্ত করা,
* জাতীয় সংকট বা অচলাবস্থা চলাকালে রাষ্ট্রপতি কতৃক আদালতের নির্দেশনা নিয়ে, অথবা তা ব্যতিরেকেই                    স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাতে ফলপ্রসূভাবে নাক গলানোর ক্ষমতা।

রাষ্ট্রপতির নিকট উপরিউক্ত কতৃত্বসমূহ ন্যস্ত করলেও প্রধানমন্ত্রীই নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী থাকবেন। বিদেশে প্রধানমন্ত্রীই দেশের নেতৃত্ব দেবেন। তবে এভাবে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রধানমন্ত্রীর একাধিপত্য তিরোহিত হবার সুযোগ সৃষ্টি হবে, এবং ক্ষমতার শীর্ষ বলয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পরিস্থিতির বাতাবরণ সৃষ্টি হবার সুযোগ পাবে।

উপরিউক্ত সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়িত হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়াতেও সংশোধনী আনার প্রসঙ্গ এসে হাজির হবে। সেক্ষেত্রে শুধু সাংসদদের বদলে সাংসদ থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের মহিলা মেম্বার পর্যন্ত- অর্থাৎ এদেশের প্রত্যেকটি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ভোটার করা যেতে পারে। ভোট অবশ্যই হতে হবে গোপন ব্যালটে, এবং উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত পোলিং বুথ স্থাপন করতে হবে। আমি আরও মনে করি, যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর নিকট নির্বাহী ক্ষমতা থাকছে, সেহেতু জনগনের সার্বজনীন ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করার দরকার নেই। কারণ এটা সময় ও অর্থের অপচয় ঘটাবে…।

যুক্তফ্রন্টের পতন ও কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন

 

224875_654653431343045_4298290759612608606_n
১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গের নির্বাচিত প্রাদেশিক মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দ: সামনের সারি (বাম থেকে ডানে): খয়রাত হোসেন, শেখ মুজিবর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক, আতাউর রহমান খান, বসন্ত কুমার দাস এবং মোহাম্মদ আলী। পেছনের সারি (বাম থেকে ডানে): আবদুর রহমান খাঁ, মনোরঞ্জন ধর, মশিউর রহমান, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং মনসুর আলী।

 

১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা গ্রুপ ছবি এটি। সেই বছরের এপ্রিল ও মে মাসে মাত্র কয়েকদিন ক্ষমতায় ছিল এই জোট। এতো যৎসামান্য সময় ক্ষমতায় থাকা খুব কম সরকারের পক্ষেই ইতিহাসে এভাবে স্থান পাওয়া সম্ভব হয়েছে। এমনিতে প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তফ্রন্ট সরকার তেমন কোন অবদান রাখেনি। এপ্রিলের ৩ তারিখ প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক আরও চারজন মন্ত্রী সহ শপথ গ্রহণ করেন। এরপর জোটে মন্ত্রিত্বের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে ব্যাপক টানাপড়েনের পর মে মাসের ১৫ তারিখ মন্ত্রীসভা এই ছবির আকারে সম্প্রসারিত হয়। বলা বাহুল্য, এই কয়দিনে গৃহবিবাদ, কলহ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির হঠাৎ অবনতি, নিজ জোটের নেতা মাওলানা ভাসানীর অনমনীয় ও হঠকারী আচরণ, ঢাকায় ভুখা মিছিলের আধিক্য হঠাৎ বেড়ে যাওয়া সামলাতেই নাকাল হতে হয়।

শপথ গ্রহণের দুই মাস পূর্ণ হবার আগেই বড়লাট গোলাম মোহাম্মদ এই সরকার বরখাস্ত করেন আইনশৃঙ্খলা ও শাসনের অপ্রতুলতার অজুহাতে। এছাড়াও আরেকটি কারণে এই সরকারকে বরখাস্ত করতে গভর্নর জেনারেল অজুহাত পান বলে শোনা যায়। আর সেটি হচ্ছে, ১৫ মে মন্ত্রীসভার পূর্ণ রূপ দানের পর ফজলুল হক করাচী সফর করেন। সেখান থেকে ফেরার পথে কলকাতায় যাত্রাবিরতি করার সময় পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায় পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রীকে (তখন পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার প্রধানরা প্রিমিয়ার নামেই অভিহিত হতেন) নাগরিক সংবর্ধনায় ভূষিত করেন। দীর্ঘদিন পর নিজের পুরানো কর্মক্ষেত্রে গিয়ে আপ্লুত হয়ে বৃদ্ধ শের-ই-বাংলা যা বলে বসেন, তার মানে হচ্ছে, মানচিত্রের মধ্যে দাগ কেটে দীর্ঘদিন বাংলাকে বিভক্ত রাখা যাবেনা।

স্বভাবতই পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রীর এহেন উক্তিকে করাচীর কুতুবগণ বিচ্ছিন্নতাবাদের প্ররোচণা বলে ধরে নেন। এর ফলে কার্যত তেজগাঁও বিমানবন্দরে শের-ই-বাংলাকে বহনকারী ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজের বিমান অবতরণের আগেই পূর্ববঙ্গে তখত উল্টে যায়।

তবে এতো বছরেও যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতনের পেছনের একটি বড় কারণ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়নি। সেসময়ে সংঘটিত সহিংস ভুখা মিছিল, বাঙ্গালী-বিহারী দাঙ্গার বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করলে আমার মনে হয়, যুক্তফ্রন্টের পতনের পেছনে কোন বিদেশী গেয়েন্দাসংস্থার হাত ছিলো। তারাই মাওলানা ভাসানীকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের একাংশকে কাজে লাগিয়ে প্রদেশে হিংসা ও অরাজকতা ছড়িয়ে দেয়। এমনকি এই ষড়যন্ত্রে খোদ মন্ত্রীসভারই কেউ কেউ জড়িয়ে পড়ে।

তবে এখনো যে মূল প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানার বাকি, তা হচ্ছে পূর্ববঙ্গে ফজলুল হকের সরকার কারো বাড়া ভাতে ছাই দিতে কি এমন সক্ষম ছিলো যে তাকে এভাবে বহুজাতিক ষড়যন্ত্রে সরিয়ে দেয়া হয়েছিলো? কেন জোটের বৃহত্তম শরীক হয়েও আওয়ামী লীগ নিজের সরকারের বিরুদ্ধে নেমেছিলো? অধিকিন্তু তখন নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ সভাপতি মাওলানা ভাসানী ও প্রাদেশিক সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান কেন যুক্তফ্রন্টের পতনে দৃশ্যত নিষ্কৃয় থাকেন, তা জানতে হবে।

ইদানিং আরেকটি নতুন আবিষ্কৃত তথ্য সম্পর্কে জানার পর এর সাথে যুক্তফ্রন্টের পতনের একটা সম্ভাব্য যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছি। আর তা হচ্ছে, যেসময় যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়, সেসময়ই ঢাকার কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটি থেকে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ তিব্বতে গোপন গোয়েন্দা অভিযান চালাচ্ছিল। এই ঘাঁটি ব্যবহার করে তিব্বতে অস্ত্রও প্রেরণ করা হচ্ছিলো। যুক্তফ্রন্টে এমন অনেক লোক ছিলেন, যারা কমিউনিস্ট বলে কথিত, অথবা যুক্তফ্রন্টের এমন কিছু ঘোষিত কর্মসূচী ছিল যা কমিউনিজম ঘেঁষা। ফলে হয়তো পূর্ববঙ্গে এধরণের সাম্যবাদী সরকারের টিকে থাকা তখন কোন বিশেষ মহলের জন্য সুবিধাজনক ছিলোনা। যদিও এই আশংকা অমূলক। কারণ প্রাদেশিক সরকারের পক্ষে কখনোই ঢাকা সেনানিবাসের ভেতরে তাও আবার কোন মার্কিন তৎপরতায় বাঁধা দেয়া সম্ভব হতো না।

তথাপি এই প্রসঙ্গে আরেকটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়ের অবতারণা করি। যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাসীন হবার পর ঢাকার পল্টন ময়দানে আয়োজিত এক সভায় ফজলুল হকের উপস্থিতিতে মাওলানা ভাসানী সরকারকে চাপ দেন, যাতে বিদেশী সামরিক জোট থেকে সরকার সরে আসে। এতদিন একে মাওলানা ভাসানীর বালখিল্যতা বলেই মনে করেছিলাম। কারণ সামরিক জোটে থাকা না থাকা কোনভাবেই প্রাদেশিক সরকারের এখতিয়ারে থাকেনা। আর পূর্ববঙ্গের একার পক্ষে কোন সামরিক জোট ত্যাগ করার কথা তো ভাবনারও অতীত ছিল। এখন বুঝি, এটা কোন অর্থহীন প্রলাপ ছিলোনা। সম্ভবত কুর্মিটোলায় আমেরিকার গোপন অপারেশন ব্যাহত করতে মাওলানা ভাসানী ও আওয়ামী মুসলিম লীগে থাকা কমিউনিস্টদের ব্যবহার করার জন্যই সামরিক জোট তাগের জন্য বেচারা ফজলুল হককে চাপাচাপি করা হয়েছিলো, চাবুক দেখিয়ে শাসানো হয়েছিলো!

যুক্তফ্রন্টের পতনে পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবী অভিজাততন্ত্রের ভূমিকা অবিদিত নয়। তবে তারাই এর পেছনে একমাত্র দায়ী ছিলোনা। এখানে অবশ্যই কোন সর্প হয়ে দংশনকারী ক্ষমতাশালী ওঝা ছিলো, যাদের অঙ্গুলি হেলনে করাচীর এলিট আর আওয়ামী লীগ উভয়েই নেচেছিলো। পুরো বিষয়টি আঁচ করতে গেলে পিলে চমকে যেতে হয় যখন দেখি, একটি প্রাদেশিক সরকারকে হঠাতে এমন সব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিলো যাতে যুগপৎ সিআইএ এবং কেজিবির হাত থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায়না! যদি জোট না হয়ে যুক্তফ্রন্ট একটি দল হতো, যা হয় আমেরিকা ঘেঁষা হতো, নয় সোভিয়েত ঘেঁষা; তাহলে হয়তো কেউ এই সরকারের পক্ষ নিতো।

কিন্তু যুক্তফ্রন্ট ছিল বারো ভূতের সমবায়ে গঠিত নেহায়েত একটি নির্বাচনী জোট। এখানে যেমন কট্টর পুঁজিবাদী ছিল, তেমনি সমাজতন্ত্রী ছিল। যেমন নেজামে ইসলাম পার্টির মতো দল ছিল, তেমনি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মতো ব্রাহ্মণ কংগ্রেসি, এবং বসন্ত কুমার দাসের মতো তফসিলি নেতাও ছিলেন। ফলত এই জোট প্রকৃতিগতই ছিল ক্ষণস্থায়ী। তবে যুক্তফ্রন্টের নাম ব্যবহার করে রাজনৈতিক লালসালু ব্যবসা ফেঁদে বসার জন্যই স্বল্পমেয়াদী এই সরকারের নাম ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে…!