✒ বঙ্গবন্ধু হত্যার তদন্ত- যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে ✒

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের নিজ বাসভবনে সপরিবারে নিহত হন। একই সাথে ধানমন্ডির আরেকটি বাড়ীতে সস্ত্রীক নিহত হন মুজিবের ভাগ্নে ও সম্ভাব্য রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী শেখ ফজলুল হক মণি। রমনায় একটি সরকারী বাংলোয় নিহত হন শেখ সাহেবের ভগ্নীপতি মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত।

দৃশ্যত ও কার্যত দেশের মওজুদা হালতে সংক্ষুব্ধ এবং ক্ষেত্রবিশেষে ব্যক্তিগত দুর্ভোগের শিকার সেনাবাহিনীতে কর্মরত ও চাকরীচ্যুত ক্যাপ্টেন ও মেজর মনসবের একদল অফিসার টোটাল সারপ্রাইজের জন্ম দিয়ে ঢাকার শহরের তিন লোকেশনে হামলা করে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের আনজাম দেন।

হত্যাকাণ্ডের অব্যবহিত পর খুনে মেজরগণ পুরান ঢাকার আগা মসিহ লেন থেকে বাকশালের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির অন্যতম জ্যেষ্ঠ সদস্য বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মুশতাক আহমদকে ট্যাংক মিছিল সহকারে বঙ্গভবনে এনে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বসিয়ে দেন।

মুশতাক প্রেসিডেন্ট হয়ে একটি দায়মুক্তি বা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারী করেন, যা অভ্যুত্থানকারীদের যাবতীয় কৃতকর্মের জন্য বিচারের আওতায় আনার পথ রূদ্ধ করে।

পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করার পর আওয়ামী লীগ ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিল করে। এই সময়ে মুজিব হত্যার তদন্ত করা হয়। সিআইডির বিশেষ ইন্সপেক্টর আবদুল কাহার আখন্দ যে তদন্ত করেন তার নিরিখেই মুজিব হত্যার ইতিহাস রচিত হয়। এতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে কর্নেল এম এ হামিদ, অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস প্রমুখের লেখা বই।

এর বাইরে আগস্ট অভ্যুত্থান নিয়ে তেমন কোন তদন্ত হয়নি। এইখানে ভুল হয়ে যায়। ফলে ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টের সেই অতি রহস্যময় ঘটনার কুশীলবরা আড়ালেই থেকে যাবার সুযোগ পায়। আমি মনে করি, আবদুল কাহার আখন্দকে দিয়ে তদন্ত করানোর সিদ্ধান্ত বিজ্ঞজনোচিত তো হয়ই নি, এতে আগস্ট অভ্যুত্থানের বদলে মুজিব হত্যাকাণ্ডের তদন্ত হয়েছে। কেবল তাই নয়, মুজিব হত্যার তদন্তও হয়েছে একটি মামুলী ফৌজদারি তদন্তের মতো।

এই প্রসঙ্গে গতকাল জেনারেল ফজলুর রহমানের সাথে ফোনে আমার বিস্তারিত মতবিনিময় ঘটে। স্যার গতবছর ‘ফিরে দেখা পঁচাত্তরের সেনা অভ্যুত্থান’ শিরোনামে একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং প্রবন্ধ লেখেন। ওই লেখাটি বেশ শোরগোল সৃষ্টি করে। বিশেষত, অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসারদের মধ্যে এই বিষয়ে হৈচৈ সৃষ্টি হয়েছিলো। কারণ পুরো ঘটনায় সেনাবাহিনীই জড়িত হয়ে পড়েছিলো।

জেনারেল ফজলুর রহমানের লেখার লিংক- https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=10213931677708752&id=1313709533

শ্রদ্ধেয় কাউবয় জেনারেল তাঁর লেখায় দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত এক রহস্যের জট সমাধানের রাস্তা খুলে দিয়েছিলেন। এবং কাজটা তিনি এতো ফলপ্রসূ উপায়ে করতে সমর্থ হয়েছিলেন যে, এই লেখার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া মৌচাকে ঢিল পড়ার মতো হয়েছিলো। ফলে আমার জন্য এটা জানা জরুরী ছিলো যে, ওই লেখা লিখতে গিয়ে কাউবয় জেনারেলের মস্তিষ্কে কোন কোন বিষয় কাজ করছিলো। স্যার এর জবাবে আমাকে যা বলেছিলেন, সেটাই আমার এই লেখার উপাদান।

বলা বাহুল্য, শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড মামুলী কোন ঘটনা ছিলোনা। প্রকৃতিগত কারণে আগস্ট অভ্যুত্থানকে মুজিব হত্যা হিসেবে, এবং বহুজাতিক ষড়যন্ত্রের ফসল মুজিব হত্যাকাণ্ডকেও একটি সাধারণ মার্ডার কেসের মতো তদন্ত করে পুরো বিষয়টিকেই খাটো করে ফেলা হয়েছে। এজন্যই বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসের একটি ঝলমলে অধ্যায়ের মধ্যমণি হয়েও শেখ সাহেব আদতে একজন ট্র্যাজিক চরিত্র হিসেবেই প্রতিভাত হচ্ছেন।

বস্তুত, আগস্ট অভ্যুত্থানের বিষয়ে সঠিক তদন্ত করতে গেলে কেবল জাতীয় প্রসঙ্গই নয়, সমসাময়িক আন্তর্জাতিক বিষয়েও বিশদ জ্ঞান ও বিশ্লেষণের প্রয়োজন। প্রয়োজন এসব বিষয়ে বিভিন্ন স্বাধীন উৎসে থাকা বিচ্ছিন্ন তথ্য ও উপাত্তকে ক্ষুরধার বিশ্লেষণের মাধ্যমে সাজিয়ে, কতিপয় মিসিং লিংককে ইতিহাসের যৌক্তিক রূপকল্পের মাধ্যমে সাজিয়ে ফ্যাক্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।

ফলে পৃথিবীর খুব কম ব্যক্তি বা সংস্থারই মুরোদ রয়েছে এমন একটি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করার। এটা একটা সুকঠিন বিষয় বলেই বহু রাষ্ট্রনায়কের হত্যার বস্তুনিষ্ঠ তদন্ত হয়নি। আর শেখ মুজিব তো ওই সকল রাষ্ট্রনায়কগণের মধ্যে আলাদা মরতবার অধিকারী। কারণ, তিনি বিশ্বের অন্যতম জনবহুল এবং ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী রেসকোর্সে প্রদত্ত ভাষণে তাঁর নিজের দাবী অনুযায়ী বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণভ্রমরা।

তাঁকে কেবল হত্যাই করা হয়নি, সপরিবারে বিলুপ্ত বা এলিমিনেট করা হয়েছিলো। ফলে এটা সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, এই কাজটা কয়েকজন জুনিয়র মেজরের পরিকল্পনায় তো ঘটেই নাই, এমনকি এটা অল্প কয়েক দিনের পরিকল্পনাও নয়। আমার মনে হয়, বঙ্গবন্ধুকে এলিমিনেট করার ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে শুরু করে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী থেকেই।

ফলে এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করার দায়িত্ব সিআইডির একজন পরিদর্শককে দেয়াতে একটি বুনিয়াদী ভুল হয়েছে। সিআইডির কাজ স্থানীয় পর্যায়ের খুনখারাবির তদন্ত করা। প্রকৃতিগতভাবেই এই সংস্থা একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের তদন্ত করার মতো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপ্তির অধিকারী নয়।

কারণ এর তদন্তের জন্য আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতির সমসাময়িক গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে গভীর জানাশোনা যেমন জরুরী, তেমনি সামরিক বাহিনীর মনস্তত্ত্ব, কমান্ড ফাংশনিং সম্পর্কে গভীর জ্ঞান থাকাও জরুরী। উপলব্ধিতে নেয়া উচিত ছিলো যে, খুনে মেজরগণ কি এমন সংক্ষুব্ধ হবার মতো পরিস্থিতিতে ছিলেন যে বাড়ীর নারী, শিশুদেরও তাদের মারতে হলো। অনেকেই বলতে পারেন, এগুলো বিভ্রান্ত ও উশৃঙ্খল সৈন্যদের কাজ হতে পারে। কিন্তু এটা প্রচলিত তথ্যের দ্বারাই প্রতীয়মান হয় যে, অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি ও বেঙ্গল লান্সারের অফিসাররা অভ্যুত্থানকালে পূর্ণরূপে কমান্ডের অধিকারী ছিলেন। এবং পেশাদার সৈন্যদের দ্বারা নিরস্ত্র নারী, শিশুকে গুলি করা কোন স্বাভাবিক ঘটনা নয়। নিরস্ত্রদের খুন করার আরেকটি পাইকারি নজির বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছিলো ২০০৯ সালের পীলখানা হত্যাযজ্ঞের সময়। সেই ঘটনা নিয়েও রহস্য কম ঘনীভূত হয়নি। কান পাতলে এখনো সেসবের কথা বাতাসে ভাসতে শোনা যায়।

কাকতালীয় হোক বা না হোক, পীলখানা হত্যাযজ্ঞের তদন্তকার্যেও সেই আবদুল কাহার আখন্দকেই অবতীর্ণ হতে দেখা যায়।

আগস্ট অভ্যুত্থানে অন্য কোন কিলার গ্রুপের অস্তিত্ব ছিলো কিনা, সেদিকে যাবারই চেষ্টা করা হয়নি। চেষ্টা করা হয়নি কোন বিকল্প সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার।

যেমন, ইরানের রক্ষণশীল দৈনিক কেইহান অভ্যুত্থানের দুই দিনের মাথায়ই ১৯৭৫ সালের ১৭ আগস্ট বাংলাদেশের পটপরিবর্তন বিষয়ে একটি দীর্ঘ এবং অভিনব তথ্যবহুল প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ১৯৪৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই পত্রিকা দাবী করে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে একটি নয়, বরং দুটি পাল্টাপাল্টি অভ্যুত্থান ঘটে। কমিউনিস্টদের অভ্যুত্থান শুরু হয় ভোররাত সাড়ে তিনটার পর। এতে বঙ্গবন্ধু নিহত হন। ডানপন্থীরা ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে পাল্টা অভ্যুত্থান করে, যাতে কমিউনিস্ট অভ্যুত্থানকারীরা নিহত হয়। রিপোর্টের সূত্র হিসেবে কেইহান এএফপির বরাত দেয়।

কেইহানের সেই অদ্ভূতুড়ে প্রতিবেদনে দাবী করা হয়, বাংলাদেশ সরকারের মস্কোপন্থী অংশ কয়েক মাস যাবত অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করছিলো। এদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুর দ্বারা পদচ্যুত বা দূরে সরে যাওয়া নেতারাও ছিলেন। কেইহানের প্রতিবেদনে এহেন মস্কোপন্থীদের মধ্যে যাদের নাম এসেছে, তারা হচ্ছেন- তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুস সামাদ আজাদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, আবদুর রব সেরনিয়াবাত, কোরবান আলী, মস্কোতে নিযুক্ত বাংলাদেশের দূত, শেখ মুজিবের দুই আত্মীয় প্রমুখ।

এরা নাকি কমিউনিস্ট অভ্যুত্থানকারীদের সহায়তা ও সমর্থন করেন। তবে দ্বিতীয় অভ্যুত্থানে খন্দকার মুশতাকের নেতৃত্বে ডানপন্থীরা এদের পরাজিত করে।

কেইহানের উপরিউল্লেখিত দাবীতে সত্যতা নাও থাকতে পারে, তবে এটা অনস্বীকার্য যে, আগস্ট অভ্যুত্থান আসলে আমাদের ধারণার চেয়েও গরল ও জটিল এক রক্তাক্ত রাজনীতি ছিলো। এটা অবশ্যই আন্তর্জাতিক প্রণোদনা ছাড়া সংঘটিত হয়নি। এমনকি ভবিষ্যতে যদি এটা কখনো প্রতীয়মান হয় যে, আগস্ট অভ্যুত্থানের অপারেশনাল প্ল্যানিংও বাইরে থেকে আসা, তাহলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না।

জেনারেল ফজলুর রহমান তাঁর পূর্বোক্ত লেখায় লিখেছেন, সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্যে এই অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডেও সেনাবাহিনীর কতিপয় পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারকে কাজে লাগানো হয়ে থাকতে পারে। এর পেছনে সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য ছিলো, ক্রমান্বয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের সামরিক, বেসামরিক সংস্থাপনকে শেষ করে দিয়ে একটি ভিন্ন ধারার সংস্থাপন তৈরি করা। আর এহেন কাজে সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিলো শেখ মুজিব ও জিয়াউর রহমানের মতো শক্তিশালী নেতৃত্ব।

এর বাস্তবায়নের কৌশলের স্বরূপ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে জেনারেল ফজলুর রহমান আমাকে যে বিষয়গুলোতে দৃষ্টি দিতে বলেন, সেগুলো হচ্ছে-

১। এক্ষেত্রে যদি উদাহরণ হিসেবে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও জেনারেল আবুল মঞ্জুরের কথা আনা হয়, তাহলে দেখা যাবে মুজিব হত্যার আগে বহু অপেক্ষাকৃত চৌকশ অফিসারকে টপকে কার্যত অনুল্লেখ্য ক্যারিয়ারের অধিকারী কর্নেল এরশাদকে এনডিসি কোর্স করতে ভারতে পাঠানো হয়েছিলো। একই সময়ে দিল্লীস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনে ডিফেন্স অ্যাডভাইজর করে পাঠানো হয় কর্নেল মঞ্জুরকে। শেখ সাহেবের হত্যার পরপরই দুজনই নিজেদের দায়িত্ব অসমাপ্ত রেখে ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের যথাযথ অনুমোদন ব্যতিরেকে হুট করে ঢাকায় ফিরে আসেন। তাঁদের উভয়ের আচমকা উপস্থিতিই সেনানিবাসে বিস্ময়ের উদ্রেক করেছিলো। খোদ উপপ্রধান সেনাপতি জেনারেল জিয়া তাঁদের ঢাকায় আসার বিষয়ে বিস্মিত হয়ে কৈফিয়ত তলব করে তাঁদের অবিলম্বে ফিরে যেতে বলেছিলেন মর্মে বিভিন্ন বইতে উল্লেখ আছে। জেনারেল ফজলুর রহমান নিজেই এই কথা সেই সময় জেনারেল জিয়ার পাশে থাকা কর্নেল (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) আমীন আহমদ চৌধুরীর মুখে শোনেন।

আবার ছয় বছর পর ১৯৮১ সালের ৩০ মে দেখা গেলো জেনারেল মঞ্জুর প্রেসিডেন্ট জিয়াকে অপহরণ করতে উদ্যোগী হয়েছেন, এবং প্রেসিডেন্ট তাঁর প্রধান সেনাপতির তরফে কোন সহায়তা না পেয়েই মারা পড়লেন। আবার প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর পর এরশাদ পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করা জেনারেল মঞ্জুরকে সেনা হেফাজতে নিয়ে নিলেন। বাকি ইতিহাস তো সবারই জানা।

মুজিব হত্যা ও আগস্ট অভ্যুত্থানের বস্তুনিষ্ঠ তদন্তে এই আপাত সম্পর্কহীন বিষয়গুলোরও দূরবর্তী যোগসূত্র খোঁজা উচিত ছিলো, যা একজন সিআইডি ইন্সপেক্টরের পক্ষে অসম্ভব। এর কারণ জেনারেল জিয়ার হত্যার পরই সেনাবাহিনীর কমান্ড, এমনকি দেশের সার্বিক কতৃত্ব পুরোপুরিভাবে পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারদের নিকট চলে যায়।

২। বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর আবদুল কাদের সিদ্দিকী ভারতে পালিয়ে যান। ভারতে অবস্থা ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, তথা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি কাদের সিদ্দিকীর গভীর ভালবাসা থাকতেই পারে। কিন্তু ভারত তাঁকে কেন সাগ্রহে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলো? মুজিব হত্যার আগে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিলো। ১৯৭৪ সালের শেষের দিকে ভুট্টোর বাংলাদেশ সফরে এটা আরো স্পষ্ট হয়ে পড়ে। অধিকিন্তু, বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায়ই পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনী নামের সশস্ত্র সংগঠনের সৃষ্টি হয়। ত্রিপুরা ও মিজোরামে আশ্রয়, প্রশ্রয় আর অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে এরা দীর্ঘদিন পাহাড়ে বাংলাদেশের জাতীয় অখণ্ডতা ও সংহতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থাকে। এসব বিষয়ে গভীর বিশ্লেষণের প্রয়োজন ছিলো। যা প্রকারান্তরে আগস্ট অভ্যুত্থানের পূর্বাপর নিরুপণে কাজে লাগতে পারতো।

৩। ১৯৭৩ সাল থেকে সেনাবাহিনীতে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানে আটক বাঙ্গালী সৈন্যদের প্রত্যাবাসন শুরু হয়। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, প্রত্যবাসন প্রক্রিয়া শুরু হবার পর থেকেই থেকেই একে একে বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব, এডিসি, এমনকি নিরাপত্তা কর্মকর্তা, বিডিআর, পুলিশ, সামরিক ও বেসামরিক প্রায় সকল গোয়েন্দা সংস্থা, এমনকি রাষ্ট্রপতির ভিজিলেন্স টিমের প্রধান হিসেবে পাকিস্তান প্রত্যাগত এবং এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশে পাকিস্তান সরকারের অধীন চাকরীতে থাকা অফিসারদের নিয়োগ দেয়া শুরু হয়। ১৯৭৫ সালের আগস্টে শেখ মুজিবুর রহমানের চারপাশে কোন মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসার ছিলেন না। এগুলো কি স্রেফ কাকতালীয় বিষয়, নাকি এগুলো পরবর্তীতে আগস্ট অভ্যুত্থান ও মুজিব হত্যাকাণ্ড তরান্বিত করতে ভূমিকা রেখেছিলো; এই বিষয়গুলোও বঙ্গবন্ধু হত্যার তদন্তে জোরালোভাবে থাকা উচিত ছিলো।

৪। আক্রান্ত হবার পর বঙ্গবন্ধু অনেকের সাহায্যই আহবান করেছিলেন। তারমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দুইজন ছিলেন তাঁর প্রধান নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল জামিল উদ্দীন আহমদ এবং জেনারেল শফিউল্লাহ। এছাড়াও আরো যেসকল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কাছ থেকে তিনি সাহায্য আহবান করে থাকতে পারেন, তারা হলেন, রক্ষীবাহিনীর রাজনৈতিক সমন্বয়ক তোফায়েল আহমেদ, ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক আবুল হাসনাত, বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান, সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার মশহুরুল হক।

কিন্তু অতীব হতাশার সাথে দেখা যায়, একটি বাহিনীও বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতার সাহায্যার্থে কিংবা তাঁর আহবানে এগিয়ে আসেনি।

কর্নেল জামিলের পদক্ষেপের ব্যাপারে তাঁর পারিবারিক সূত্রে এবং অন্যান্য প্রচলিত উৎস থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর ফোন পেয়ে তিনি একাই বেসামরিক কাপড়ে, ব্যক্তিগত গাড়ী নিয়ে ৩২ নম্বরের দিকে এগিয়ে যান। তিনি সদ্য গোয়েন্দা সংস্থা ডিএফআইয়ের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পেলেও তখনও সে দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। অর্থাৎ তখনো তিনি প্রেসিডেন্টের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা, এবং সেই সূত্রে প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের কমান্ডেন্ট। কর্নেল জামিল সপরিবারে গণভবনে থাকতেন, এবং গণভবনেই পিজিআরের ব্যারাক ছিলো।

অথচ যেকোন ফোর্স কমান্ডের এসওপি অনুযায়ী, তিনি উর্দি পরিধান করে প্রথমে ফোর্সের কাছে যাবেন, এবং তাদেরকে প্রস্তুত করে অন্যান্য অফিসারদের নেতৃত্বে অকুস্থলে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন। এবং তিনি নিজেও সামরিক পোষাকে, কমান্ডারের ইনসিগনিয়া ধারণ করে, সামরিক যানবাহনে চেপে ঘটনাস্থলে যাবেন।

অথচ আমরা দেখলাম, তিনি একাই সিভিল পোষাকে, সিভিল গাড়ীতে চেপে, প্রয়োজনীয় অস্ত্রবল ছাড়াই ধানমন্ডি গেলেন, এবং মারা গেলেন। এই রকমটা কেমন হয়েছিলো, কোন পরিস্থিতিতে কর্নেল জামিল একজন পেশাদার সেনা অফিসার হয়েও অত্যন্ত অস্বাভাবিক পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য হয়েছিলেন, তার গভীর বিশ্লেষণ অতীব জরুরী ছিলো। কারণ একজন জ্যেষ্ঠ কর্নেলের পক্ষে জরুরী সময়ে এমন কোন ভুল করা সম্ভব নয়, যা বুনিয়াদী সামরিক প্রশিক্ষণের কমান্ড প্রক্রিয়ার পরিপন্থী ।

৫। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিএফআই (বর্তমান প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতর তথা ডিজিএফআইয়ের পূর্বসূরী) মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার আবদুর রউফ ১৫ আগস্ট রাত আড়াইটার দিকে প্রথম অস্বাভাবিক ট্রুপস মুভমেন্টের খবর জানতে পারেন। তিনি চরম অস্বাভাবিকভাবে এই ঘটনা চেপে যান। এমনকি যখন নাইট ট্রেনিংয়ের নাম করে বের করা ট্যাংক মুভ করে পূর্বনির্ধারিত প্রশিক্ষণ স্থল কুর্মিটোলার বদলে দক্ষিণে শহরের দিকে ভীম আওয়াজ ছেড়ে শেষ রাতের নিস্তব্ধতা খানখান করে এগিয়ে গেলো, তখনও এই বিষয়ে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদফতর নিশ্চুপ।

ব্রিগেডিয়ার রউফকে দেখা যায় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হবার ঠিক পরপর। ভোর ছয়টার পর যখন হতবুদ্ধি প্রধান সেনাপতি জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ তাঁর বাসায় জড়ো হওয়া উপপ্রধান সেনাপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান, সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সহ পদস্থ অফিসারদের নিয়ে বৈঠক করছিলেন, তখন শফিউল্লাহর ব্যাটম্যনের সহায়তার প্রধান সেনাপতির বাড়ীর দেয়াল টপকে লুঙ্গী, গেঞ্জি পরিহিত অবস্থায় নাটকীয়ভাবে উদয় হন ব্রিগেডিয়ার রউফ।

আগস্ট অভ্যুত্থানে ব্রিগেডিয়ার আবদুর রউফের এহেন চূড়ান্ত রহস্যময় ভূমিকার তাবসেরা ছাড়া কোন তদন্ত পূর্ণতা পাবে না।

পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিষয়ে যখন আলোচিত হয়, তখন এই বিষয়ে কোনরূপ আলোচনা হয়না। সিআইডির পক্ষে ঘটনার এতোটা গভীরে যাওয়া সম্ভব হয়নি বলেই এমনটা হয়েছে।

এই বছর অন্যন্য বছরের মতো ১৫ আগস্টে জেনারেল জিয়ার পিণ্ডি চটকানোর বদলে এই ভয়াবহ ঘটনার পূর্বাপর ও নেপথ্য কুশীলবদের মুখোশ উন্মোচনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বেশি। শেখ সেলিম, হাছান মাহমুদের মতো অনেকেই জাতীয় কমিশন গঠন করে মুজিব হত্যার নেপথ্য কারিগরদের খুঁজে বের করার কথা বলেছেন। ১৮ আগস্ট যায়যায়দিনে আগস্ট অভ্যুত্থানের অধিকতর তদন্তের লক্ষ্যে জাতীয় কমিশনের রূপরেখা প্রকাশিত হয়েছে। এতে দেখা গেলো, ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাসদের বোমাবাজি থেকে শুরু করে ঘটনার অনেক পরে ১৯৭৬ সালে জাসদ গণবাহিনী কতৃক বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনকে অপহরণের চেষ্টার ঘটনাকেও আগস্ট অভ্যুত্থানের সাথে মিলিয়ে দেখার কথা বলা হয়েছে।

এটা একটা ইতিবাচক উদ্যোগ। কারণ বস্তুনিষ্ঠ তদন্ত কেবল মুজিব হত্যাই নয়, জিয়া হত্যার পেছনের ষড়যন্ত্রের উদঘাটনেও সহায়ক প্রমাণিত হবে। আর যদি এখানে যদি আগের মতোই খেলাধুলা চলে, তাহলে এটা একটা খারাপ নজিরের জন্ম দেবে। আমাদের জন্য ডেকে আনবে বহুমাত্রিক বিপদ…।

Leave a comment