বিষয় ও বিবেচনা- রাজনৈতিক ম্যান্যুভার ও জেনারেল ফ্রাংকোর কেস স্টাডি এবং বাংলাদেশ

বিষয় ও বিবেচনা- রাজনৈতিক ম্যান্যুভার ও জেনারেল ফ্রাংকোর কেস স্টাডি এবং বাংলাদেশ

ম্যান্যুভার শব্দের অর্থ চাতুর্য ও কৌশলের সাথে দিক বদল। এর দ্বারা নিজেকে শক্তিশালী করা যায়। ম্যান্যুভার জঙ্গিবিমানের যুদ্ধ সক্ষমতার একটি অপরিহার্য অঙ্গ। তবে কখনো কখনো ম্যান্যুভার একটি অব্যর্থ রাজনৈতিক অস্ত্রেও পরিণত হতে পারে। যার দ্বারা দুনিয়া উল্টেপাল্টে গেলেও নিজেকে সংহত রাখা যায়। অবশ্য অভদ্র ভাষায় একে ডিগবাজী বলাও দুরুস্ত।

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে জাপানের সম্রাট হিরোহিতো ও স্পেনের একনায়ক জেনারেলিসিমো ফ্রান্সিসকো ফ্রাংকোর কথা। আশ্চর্য রাজনৈতিক ম্যানুভারের দ্বারা এই দুইজন দীর্ঘদিন সমহিমায় বলীয়ান ছিলেন। এমনকি এদের সাথে বিলুপ্ত যুগোস্লাভিয়ার নেতা মার্শাল জোসেফ ব্রিজ টিটোর তুলনাও অসম্ভব। কারণ এরা দুজনেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেকার লোক, বিশ্বযুদ্ধের সময় চুটিয়ে অ্যাডলফ হিটলারের সাথে দোস্তি করেছেন, আবার যুদ্ধের পর ডিগবাজীর মাধ্যমে স্নায়ু যুদ্ধের সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমৃত্যু ক্ষমতাসীন থাকতে পেরেছেন।

548867465
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির ফুয়েরার অ্যাডলফ হিটলারের সাথে গার্ড অভ অনার পরিদর্শনে স্পেনের কডিলো ফ্রাংকো।

franco-hitl
নাৎসি সালাম দিচ্ছেন ফ্রাংকো। পাশে হিটলার।

296e009f
১৯৪৫ সালে প্রশান্ত মহাসাগরীয় রণাঙ্গনের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ডগলাস ম্যাকআর্থারের সাথে জাপানের সম্রাট হিরোহিতো। হিরোহিতোর প্রধানমন্ত্রী জেনারেল হিদেকি তোজো আর বাদবাকি বেশিরভাগ জাপানী যুদ্ধবাজ ফাঁসীতে ঝুললেও, যার নামে জাপানের এই যুদ্ধ সেই হিরোহিতোই বেঁচে যান, এবং ১৯৮৮ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সিংহাসনে আসীন থাকেন।

তবে হিরোহিতো বা ফ্রাংকোর মধ্যে শেষোক্ত জনের বিষয়টি বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ হিরোহিতো রাজত্ব করতেন, কিন্তু শাসন করতেন না। কিন্তু ১৯৩৬ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সিসকো ফ্রাংকো ছিলেন স্পেনের সর্বেশ্বর- দ্য কডিলো। কডিলো শব্দের সহজ মানে হচ্ছে প্রধান বা স্রেফ ‘নেতা’।

১৯৩৬ সালে যখন তিনি প্রথম সামনে আসেন, তখন দেশ গৃহযুদ্ধ কবলিত। সমসাময়িক কালের ইউরোপের সর্বকনিষ্ঠ জেনারেল ফ্রাংকো ছিলেন উগ্র জাতীয়তাবাদী, কট্টর ডানপন্থী ও রাজতন্ত্রের সমর্থক গোষ্ঠীর নেতা। ১৯৩১ সালের গ্রীষ্মের শুরুতে সোভিয়েত মদতপুষ্ট প্রজাতন্ত্রীদের তৎপরতায় স্পেনের রাজা ত্রয়োদশ আলফন্সো সিংহাসনচ্যুত হন। মূলত এটাই স্পেনে গৃহযুদ্ধের জন্ম দেয়।

যাহোক, এরপরে বহু ঘটনা ঘটে যায়। গৃহযুদ্ধে বিজয়ী হবার ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে শেষও হয়ে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে দুশমনির অজুহাতে ফ্রাংকো নাৎসি জার্মানির সাথে হাত মেলান, এবং অক্ষ শক্তির যুদ্ধে শামিল হন। অথচ এরপর এই ফ্রাংকোকেই ১৯৫৯ সাল নাগাদ মাদ্রিদে তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডুয়েইট ডি আইজেনহাওয়ারের সাথে দেখা যায়, যিনি ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে দখলীকৃত জার্মানির মার্কিন মালিকানাধীন অংশের গভর্নর থেকে শুরু করে ইউরোপে মিত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্বও পালন করেছিলেন। এর আগে অবশ্য ১৯৫২ সাল নাগাদ আমেরিকান কোম্পানিগুলো স্পেনে তেল উত্তোলনের সুযোগও পাওয়া শুরু করেছিলো।

franco_eisenhower_1959_madrid
১৯৫৯ সালের শীতে মাদ্রিদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ডুয়েইট আইজেনহাওয়ারের সাথে স্পেনের কডিলো জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাংকো।

-
১৯৭১ সালের গ্রীষ্মে এক সামরিক কুচকাওয়াজে স্পেনের কডিলো জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাংকোর পেছনে দণ্ডায়মান প্রিন্স জুয়ান কার্লোস। ১৯৪৭ সালেই ফ্রাংকো স্পেনে পুনরায় রাজতন্ত্র চালুর ঘোষণা দেন। তবে সাথে সাথে এও সাব্যস্ত হয় যে, তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্পেনীয় সিংহাসন খালি থাকবে, এবং ফ্রাংকো রাজার গরিমায় রাজ প্রতিভূ হিসেবে থাকবেন। ১৯৬৯ সালে তিনি বিখ্যাত বুরবোঁ বংশের সদস্য ও ১৯৩১ সালে সিংহাসনচ্যুত রাজা ত্রয়োদশ আলফন্সোর পৌত্র হুয়ান কার্লোসকে নিজের মৃত্যুর পর স্পেনের রাজা হবার কমিশন দিয়ে দেন। কার্লোস রাজা প্রথম হুয়ান কার্লোস নামে ২০১৪ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করে পুত্র ষষ্ঠ ফিলিপের অনুকূলে তখত ছেড়ে দেন।

যাহোক, রাজনীতিতে ম্যান্যুভারের বিষয়ে বলতে গিয়ে জেনারেল ফ্রাংকোর প্রসঙ্গ আনার মানে এই নয় যে, তিনি ডিগবাজী দিয়ে ভালো কাজ করেছিলেন। বরং তিনি উচিত কাজ করেছিলেন। মূলত রাজনৈতিক ম্যান্যুভারের বেধড়ক প্রয়োগের দ্বারাই ফ্রাংকো যুগকে পদানত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। আসলে রাজনৈতিক ম্যান্যুভারের প্রায়োগিক বর্ণনা দিতে গেলে এক কথায় বলা চলে, রাজনৈতিক ম্যান্যুভার আসলে পাত্র অনুযায়ী আকার ধারণ করার বিদ্যা বা কৌশল। আমাদের সামরিক শাসক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও প্রশংসনীয় দক্ষতায় রাজনৈতিক ম্যান্যুভার দেখাতে পারেন। তবে ফ্রাংকোর সাথে এরশাদের পার্থক্য হচ্ছে, ম্যানুভার করতে গিয়ে ফ্রাংকো নিজেকে লেজেগোবরে অবস্থায় ফাঁসতে দেননি।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্ব রাজনীতিতে ম্যানুভারের  প্রয়োজনীয়তা কার্যত ফুরিয়ে গেছিলো। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন এক মেরুর বিশ্ব ছত্রখান হয়ে পড়ায় এখন আবার রাজনৈতিক ম্যান্যুভার বা ভাণ্ড অনুযায়ী আকার ধারণের আবেদন ফুরিয়ে এসেছে। এটা বিশেষত সেই দেশগুলোর ক্ষমতাসীনদের জন্য প্রযোজ্য, যাদের দেশ রুশ-চীন আর আমেরিকার রশি টানাটানিতে আছে। বাংলাদেশও তেমন দেশের অন্যতম।

সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকার এশীয় নায়েব ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্যে ছিল বাংলাদেশ। এই সময়ে বাংলাদেশের সরকারকে কোনোরূপ ম্যান্যুভার তো দূরে থাক, ভারসাম্য রাখার চেষ্টাও করতে হয়নি। কিন্তু চলতি মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফর, তার একদিন আগে ভারতীয় পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে ভারতের ক্রস বর্ডার অপারেশন বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ওয়াজেদের নারাজির ঘোষণা প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের, এবং তার শাসকগোষ্ঠীর পলিটিকাল ম্যান্যুভার এখন সক্রিয়ভাবে খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে। শেষমেশ আদৌ এহেন কোন ম্যান্যুভার হয় কিনা, তা পরের কথা; কিন্তু বাংলাদেশের পলিটিকাল ম্যানুভারের পাঁকে আটকে যাওয়াটা বেশ স্পষ্ট। ফলে এটা হলফ করে বলা যায়না যে আমাদের অদূর ভবিষ্যতে কি আছে! বাংলাদেশে চীনের দৃশ্যমান হবার প্রেক্ষিতে একটা সম্ভাব্য পলিটিকাল ম্যান্যুভার ও তার সাস্টেইনিবিলিটি বা টেকসই হবার পেছনে এখন অনেকের ভাগ্য জড়িত হয়ে পড়ছে…!

 

©কপিরাইট সংরক্ষিত

বাংলাদেশ কি দেউলিয়াগ্রস্ত হানজিন শিপিং কিনতে পারে?

হানজিন শিপিং বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম শিপিং ও লজিস্টিকস প্রদায়ক প্রতিষ্ঠান। পণ্য পরিবহণের সক্ষমতার বিচারে এটি বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম শিপিং কোম্পানি। ১৯৭৭ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় স্থাপিত এই প্রতিষ্ঠানের দুইশর মতো সমুদ্রগামী বৃহদাকার কার্গোবাহী জাহাজ আছে। ৬০ দেশে ২৩০ দফতর ও সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের অধিকারী হানজিনের আছে কয়লা, তেল ও এলএনজিবাহী জাহাজও। কিন্তু হঠাৎ শুরু হওয়া বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে চলতি বছরের শুরু থেকেই হানজিন শিপিং দেউলিয়া হতে শুরু করে। মোট ৫.৪১ বিলিয়ন ডলারের দায় আছে এর ঘাড়ে। সম্প্রতি দেশটি দেনার জালে আটকানো অবস্থা থেকে মুক্তি পাবার জন্য আর্থিক প্রণোদনা, আইনি সুরক্ষার আবেদন জানিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছে হানজিন শিপিং। সম্প্রতি কোম্পানিটি তার একটা বিরাট অংশ বিক্রি করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারীভাবে হানজিন শিপিংয়ের একাংশ কিনে নিতে পারে, যার অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্ভাবনা অপরিসীম।

9l-hanjin-shipping

সম্প্রতি বাংলাদেশের জন্য সমুদ্র বাণিজ্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নিজস্ব উদ্যোগ ছাড়াও অবস্থানগত সুবিধার কারণে এদেশে বিদেশী উদ্যোক্তারাও ভিড় করছে। এদেশে দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, জাপানের মতো দেশ সরাসরি বিনিয়োগ শুরু করেছে। এসব দেশের জন্য স্থাপন করা হচ্ছে, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। কেবল চীনই বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসারে বিভিন্ন দিক থেকে ভূমিকা রাখছে। আজ সমাপ্ত হওয়া চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের দুই দিনের ঢাকা সফরের প্রেক্ষিতে বস্ত্র, চামড়াজাত পণ্য, পেট্রো কেমিকেলস ইত্যাদি রপ্তানি পণ্যে বিনিয়োগ ছাড়াও বড় শিল্প স্থাপনে চীনা বিনিয়োগ ও সহযোগিতার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়েছে। শুধু তাই নয়, জ্বালানী ও বিদ্যুৎ খাতে গৃহীত সরকারী নীতিই এখন সমুদ্র বাণিজ্যের দিকে বাংলাদেশের মরিয়া দৃষ্টির জন্য যথেষ্ট। দেশে বেশ কিছু মাঝারি ও বড় মাপের কয়লা ও তরলীকৃত গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। গ্যাসের উপর চাপ কমাতে সরকার ২০২১ সাল নাগাদ দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশই কয়লা ভিত্তিক করতে চাচ্ছে। এসব বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে যেমনি কার্যকর, তেমনি সম্পূর্ণ আমদানি নির্ভর কাচামাল হওয়ায় এক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বাবলম্বী হওয়া জরুরী হয়ে পড়েছে।

সম্প্রতি ব্লু  ইকনমির কথা বেশ চাউর হয়েছে। বাংলাদেশের ব্লু  ইকনমি এখনও নেহায়েত শিশু পর্যায়ে। একে ঘিরে আমাদের অনেক স্বপ্ন সাধের বেসাতী ইতোমধ্যেই রচিত হয়ে গেছে। ব্লু  ইকনমি আর বড় বড় সমুদ্রগামী জাহাজ কার্যত সমার্থক। আর বাংলাদেশের ব্লু  ইকনমির জন্য অধিক সংখ্যায় বাংলাদেশী পতাকাবাহী, অথবা নিজস্ব মালিকানাধীন জাহাজের বিকল্পও নেই। বাংলাদেশ বর্তমানে সমুদ্রগামী জাহাজ নির্মাণেও নিজের দক্ষতার ছাপ রাখতে শুরু করেছে। কিন্তু সমুদ্রগামী জাহাজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া বাংলাদেশের স্বপ্ন হলেও তা বাস্তবায়ন একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়ার অংশ। অথচ আল্লাহ তার আগেই আমাদের সামনে এক সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে, যা হাতছাড়া হলে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

হানজিনের শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ কেবল প্রচুর সমুদ্রগামী জাহাজ নিজের অধীনেই পাবেনা, বরং ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত এর বিস্তৃত নেটওয়ার্ক আর অভিজ্ঞ কর্মশক্তির সুবিধা ষোল আনাই পেয়ে যাবে। সমুদ্রে আধিপত্য কেবল নৌবাহিনীর রণতরীর উপরই নির্ভর করেনা, বরং অধিক সংখ্যক বাণিজ্যিক জাহাজের মালিকান সমুদ্রে কোন দেশের আধিপত্য প্রকাশের জন্য প্রধান নির্ণায়ক বিষয়। তাছাড়া সমুদ্রগামী জাহাজের রণকৌশলগত তাৎপর্যও ফেলনা নয়।

আমরা জানি, ফানেল আকৃতির বঙ্গোপসাগর বৈদেশিক শক্তির দ্বারা বাংলাদেশের জন্য অবরোধ আরোপের জন্য অনেকটাই সহায়ক। এটা বাংলাদেশের একটা সীমাবদ্ধতা। এই সীমাবদ্ধতার সামরিক সমাধান হিসেবে একটি শক্তিশালী ব্লু  ওয়াটার নেভি প্রতিষ্ঠা করার কথা হচ্ছে। কিন্তু সেই তুলনায় অবরোধের সময় সমুদ্র বাণিজ্য চালু রাখার উপায় নিয়ে কম কথা হচ্ছে। এখানে আমার বক্তব্য স্পষ্ট। যদি বর্তমান ভূরাজনৈতিক অস্থিরার ডামাডোলে বাংলাদেশের সামনে কোন বৈদেশিক শক্তির দ্বারা সমুদ্র অবরোধে নিপতিত হবার সুযোগ সৃষ্টি হয়, তবে তার সরাসরি মোকাবিলায় থাকবে নৌবাহিনী। কিন্তু নৌবাহিনীর রক্ষাকবচের পেছনে সমুদ্র বাণিজ্য চালানোর জন্য প্রয়োজন হবে নিজস্ব জাহাজের। কোন অনিশ্চিত পরিবেশে অন্য দেশের পতাকাবাহী জাহাজের উপর বাংলাদেশ ভরসা রাখতেই পারবে না।

অর্থাৎ এখন সময় এসেছে ছোট চিন্তার বদলে বড় চিন্তা করার। আমাদের জন্য একটা ফ্রিগেট বা ডেস্ট্রয়ারের পেছনে প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী অন্তত দুটি জাহাজ। আর এক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য বড় সুযোগ নিয়ে এসেছে দক্ষিণ কোরীয় জায়ান্ট হানজিন শিপিংয়ের দেউলিয়াত্ব। সঠিক অংক আমার জানা নেই, তবে বাংলাদেশের প্রাথমিকভাবে মাত্র ৮০০ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন লাল বাতি জ্বলার অপেক্ষায় থাকা হানজিনের বড় একটি শেয়ার কিনে নেয়ার জন্য। বাংলাদেশ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় বা সমুদ্র পরিবহণ অধিদফতরের নামে এই শেয়ারগুলো কিনতে পারে। এখন বাংলাদেশের জন্য ৮০০ মিলিয়ন ডলার জোগাড় করার মতো সহজ উৎসের অভাব আছে কিনা, সেটা আশা করি চিন্তাশীল মাত্রেই উপলব্ধিতে পারঙ্গম।

আমাদের সম্ভাবনার সীমা আকাশ। আমাদের স্বপ্ন আর উদ্যোগের সীমাও অনুরূপ হওয়া উচিত। পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম এই জনগোষ্ঠী কি চিরাচরিতভাবে চেয়ে চেয়ে দেখেই যাবে, নাকি নতুন যুগের বজ্রনির্ঘোষ ঘোষণা করবে, তার সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়ভার আমাদেরই। আগামী বছর নির্বাচন হবে কি হবেনা, ডোনাল্ড ট্রাম্প জিতবে কি জিতবে না, এহেন শিশুতোষ ও দেহাতী চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে আমাদের সামনে অগ্রসর হতে হবে। মাথা নিচু করে, বা পেছনের সারিতে থেকে নয়, বরং স্বাভাবিক ঋজুত্বের সাথে দাঁড়িয়ে সকলের সাথে তাল মিলিয়ে স্বার্থ উদ্ধারেই বাংলাদেশের সোনালী স্বপ্নের বাস্তবায়ন নিহিত…।

©কপিরাইট সংরক্ষিত

সমালোচকের দৃষ্টিতে পর্যটন- সাজেক ভ্রমণ

সমালোচকের দৃষ্টিতে পর্যটন- সাজেক ভ্রমণ

প্রথমেই পরিষ্কার করে নেই যে, সমালোচনার মানে কেবল নেতিবাচক নয়, বরং সমালোচনা কোন বিষয়ের উপর সার্বিক পর্যবেক্ষণেরই একটি বর্ধিত পর্যায়। ফলে সাজেক সম্পর্কে ক্ষুদ্র বিবেচনায় যা লিখতে যাচ্ছি, শুরুতেই তার ব্যাপারে একদেশদর্শী ধারণা গড়ে না নিলেই আমি স্বস্তি পাবো। কেবল গেলাম, দেখলাম, উপভোগ করলাম- এই দস্তুরে আমি সাজেক দেখিনি বলেই এখানে সমালোচনার প্রশ্ন এসেছে। সাজেকের অনিন্দ্য সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখেই আমি বসে থাকিনি। আমি বিভিন্ন নিষ্ক্রিয় উৎস থেকে তথ্য নিয়েছি অকাতরে, আমার মস্তিষ্কের বিশ্লেষক অংশ ছিল সক্রিয়।

যাহোক, আমার সাজেক যাত্রা একটি নজিরবিহীন ইতিহাসই বটে! সম্ভবত মে মাসে আমার মনে হয়েছিলো আগস্টের ২৫ তারিখের ছুটির ফাঁদে আমার কোথাও ঘুরতে যাওয়া উচিত। প্রথমে ঠিক করলাম ঢাকা শহরকেই একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখবো। তারপরে ঠিক হল সাজেক যাবার। আগস্টের মাঝামাঝি এসে যাদের সাথে সাজেক যাবার কথা, তাদের প্রবঞ্চনার শিকার হয়ে ২২-২৩ তারিখের দিকে সাজেক যাবার পরিকল্পনা বাদ দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। এরপর আমার মনে জেদ চেপে যায়। ২৫ তারিখ গেলাম বিছনাকান্দি। তারপর গতমাসে গেলাম কক্সবাজার। সামনে আরও কোথাও যাবার ইচ্ছা আছে। অর্থাৎ সাজেক আমাকে পুরো দস্তুর ঘরাঘুরির নেশায় আসক্ত করে ফেললো!

বেশ কয়েকবার সময় বদলানোর পর অবশেষে গত শুক্রবার রওয়ানা দিলাম সাজেকের দিকে। শুধু নিসর্গ বিলাস নয়, বরং পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে আরেকটু ধারণা নিতেই আমি যাত্রাপথে কল্পনা ভাজছিলাম। পার্বত্য চট্টগ্রামে এটা আমার দ্বিতীয় ভ্রমণ। এর আগে ২০১২ সালে বান্দরবানের সুদূর দুর্গম উপজেলা থানচি সফরে গেছিলাম আমি। আমার সৌভাগ্যই বলা চলে যে, দুইবারই আমি শহরের বদলে পাহাড়ের আসল পরিবেশের কাছাকাছি থাকতে পেরেছি।

যাহোক, রাষ্ট্রীয় বিধানে সাজেক রাঙ্গামাটি জেলার অংশ হলেও খাগড়াছড়ি জেলা হয়ে যাওয়া ছাড়া সহজ উপায় নেই। কয়েক বছর আগেও সাজেক ছিল অতি দুর্গম এক জনবিরল জনপদ। শুনেছি মাত্র বছর দশেক আগেও সাজেক যেতে সেনাবাহিনীর নিকটস্থ জোনাল হেডকোয়ার্টারে ‘মৃত্যুর জন্য আমি নিজে দায়ী’ এমন মুচলেকা দিয়ে যেতে হতো। একটা সময়ে এমনকি দীঘিনালা থেকেই পায়ে হেঁটে সাজেক পৌঁছাতে চলে যেতো চারদিন! অথচ এখন পুরোটা পথই পিচ ঢালা পথ।

খাগড়াছড়ি যাবার রাস্তা দুইটা। আমরা গেছিলাম মীরসরাইয়ের বারইয়ারহাট হয়ে যে রাস্তাটি গেছে সেটি হয়ে। বারইয়ারহাট ছেড়ে কিছুদূর গেলে জোরওয়ারগঞ্জ নামে একটি বড় বাজার পড়ে। এটি ফটিকছড়ি উপজেলায় পড়েছে। মনে হল, জোরওয়ারগঞ্জ থেকেই আসলে পাহাড়ের শুরু। এই এলাকাটি আসলে ফুট হিলস। এখান থেকেই রাস্তা উঁচুনিচু হতে শুরু করে। ধীরে ধীরে সমতল থেকে উপরের দিকে উঠে যাবার অনুভূতি জাগে। এখানে একটা বিষয় প্রণিধানযোগ্য। তা হচ্ছে, সাজেকে যখন তখন যাওয়া যায়না। যেহেতু এলাকাটি অত্যন্ত প্রত্যন্ত, এবং এখনও সশস্ত্র পাহাড়ি গোষ্ঠীসমূহ সম্পূর্ণভাবে অস্ত্র সম্বরণ করেনি, সেহেতু দিনে মাত্র দুইবার সেনাবাহিনী বা বিজিবির সশস্ত্র পাহারায় সাজেকগামী যানবাহন চলাচল করতে পারে। সব যানবাহন প্রথমে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে এসে সমবেত হয়। সেখানে সেনাবাহিনীর জোনাল সদরে নাম লিপিবদ্ধ করে কনভয়ে শরীক হতে হয়।

সেমতে পরিকল্পনা ছিল ভোরে রওয়ানা দিয়ে সকালের কনভয় ধরার। সহকর্মী কাম দক্ষ ট্যুর গাইডের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া কাদের ভাইয়ের সেই নিচ্ছিদ্র পরিকল্পনা শেষে সঠিক পথে অগ্রসর হয়নি। ফলে বিকাল পর্যন্ত খাগড়াছড়ি শহর, আলুটিলা, আর তারেং নামের একটি ঝর্ণা দেখে সময় গুজরান করেছিলাম। আলুটিলা দেখে মনে হলো, একে পর্যটন কেন্দ্রের পাশাপাশি হর্টিকালচার সেন্টার করার পরিকল্পনা আছে। মজার অভিজ্ঞতা হতো তারেং ঝর্ণা পরিদর্শনে। এই ঝর্ণার বেশ কিছুটা আগে পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে গাড়ী থামে। সেখানে একটি প্রলম্বিত ঢাল বেয়ে নেমে ঝর্ণায় যেতে হয়। আমি ঝর্ণায় না গিয়ে ঢালের মুখে স্থানীয় ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর স্থাপন করা কিছু টং দোকান ঘুরে দেখতে লাগলাম। দেখলাম এখানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতা আছে। টং দোকানগুলোতে বিভিন্ন শ্লোগান সম্বলিত পোষ্টার সাঁটানো, যাতে সাজেক, আলুটিলার মতো স্থানে পর্যটন জোন করার পরিকল্পনার বিরোধিতা করে বিভিন্ন দাবী পেশ করা হয়েছে। পোস্টারের দাবী অনুযায়ী, তারা উন্নয়নের চেয়ে নিজেদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি বেশি চায়। অথচ ওই ঝর্ণা কেন্দ্রিক গড়ে দোকানপাটে কোন বাঙ্গালী মালিকানা দেখলাম না। এমনকি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে পর্যটকদের ঝর্ণার কাছে নিয়ে যাবার জন্য ত্রিপুরা যুবকেরা বাইক নিয়ে বসে আছে। অথচ এসব পোস্টারের পেছনে যে এরাই সক্রিয়, তা বেশ স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছিলো!

20161007_111546
আলুটিলার অনেক নিচে খাগড়াছড়ি শহর। এইখান থেকে পুরো শহরের একটি প্যানারমিক ভিউ পাওয়া যায়।
20161007_114646
মজার বিষয় হচ্ছে, যারা এসব পোষ্টার সাঁটিয়ে রেখেছে, তারাই এসব এলাকার পর্যটনের মূল সুবিধাভোগী!

খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। আমি বসেছিলাম চান্দের গাড়ীর সামনের আসনে। চালক ছিল এক বাঙ্গালী ছোকরা, যে নিজের জন্মস্থান হিসেবে দীঘিনালা ছাড়া অন্য কোন স্থানে উল্লেখমাত্র করেনি। অথচ তার বাবা-মা ছিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ভাষায় সেটেলার। যাহোক, আমি আগে বান্দরবার গেছি। সেখানকার পাহাড়ি সৌন্দর্যের সাথে সাজেকের পথের সৌন্দর্যের দৃশ্যমান পার্থক্য দেখলাম।

সাজেকে যেতে দীঘিনালা পড়ে। মিডিয়ার খবরের সুবাদে দীঘিনালা আমাদের কাছ বেশ পরিচিত। শান্তি চুক্তি সম্পাদনের এতো বছর পরও দীঘিনালার পরিস্থিতি প্রায়ই উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয়, এখানে সংঘাতের ধরণটা জাতিগত। কিন্তু দীঘিনালা অতিক্রম করার সময় আমার উপলব্ধি হল যে, পুরো বিষয়টায় আসলে পাহাড়ি ও বাঙ্গালীদের মধ্যকার অর্থনৈতিক স্বার্থের সংঘাত জড়িত। দীঘিনালা পাহাড়ের উপরে একটি সমতল ভূমির মতো। দীঘিনালার একটি বড় অংশে মাঝেমাঝে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টিলা ছাড়া পুরোটিই সমতল। ফলে এখানে ধানী জমি প্রচুর, এবং জমির চাহিদাও বেশি। এটি অদ্যাবধি দীঘিনালার অশান্ত থাকার একটি কারণ বলে মনে হল। তবে দীঘিনালা বাজারে যতো লোক সমাগম দেখলাম, তাদের মধ্যে বাঙ্গালীর সংখ্যাই বেশি বলে মনে হল। বাহ্যিকভাবে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্কই দেখা গেলো। তবে এরই মধ্যে দীঘিনালা পেরিয়ে কিছুদূর যাবার পর একটি ওয়ার্কশপের পাশে একটি স্মৃতিফলক দেখলাম, যা ১৯৯২ সালে নিহত ভরদ্বাজ মণি চাকমা নামের এক বৃদ্ধের। ফলকে তাকে সাম্প্রদায়িক হামলার শহীদ হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই সৌধের আশেপাশে দোকানপাটে বাঙ্গালী দোকানীরা বসে আছে। আমি ভাবলাম, যদি সাম্প্রদায়িক হামলাতেই এই ব্যক্তি নিহত হয়ে থাকেন, তবে এতদিন পর এই সৌধ থাকার তো কথা নয়!

20161008_144615
ভরদ্বাজ মণি চাকমার সমাধি

দীঘিনালা থেকে বের হয়ে বাঘাইহাট সেনা জোনের এলাকা পার হবার পর থেকেই পাহাড়ের আসল সৌন্দর্য চোখের সামনে ধরা দিতে থাকে। এসব এলাকায় তেমন গভীর জঙ্গল নেই। মাঝেমাঝে কয়েকটি ঘর মিলে একটি বসতি। ছেলেপেলেরা সেনাবাহিনীর ১৯ ইসিবির তৈরি করা রাস্তা দিয়ে ধাবমান চান্দের গাড়ীর দিকে চেয়ে থাকে। মাঝেমাঝে কেউ কেউ হাত নাড়ে। আমাদের ড্রাইভারের মতে এরা নাকি আসলে এভাবে পর্যটকদের কাছে টাকা চায়। পুরো এলাকায় জুম চাষের বদলে ফলের চাষ বৃদ্ধির করার প্রভূত প্রচেষ্টা দেখা গেলো। আমি পথের ধারে তেজপাতা, পিচফল ইত্যাদির প্রদর্শনী খামার দেখেছি। একটা বিষয় আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে, পর্যটনের পাশাপাশি কৃষির দিক থেকেইও পার্বত্য অঞ্চলকে বিশেষায়িত করার চেষ্টা আছে। এমন প্রত্যন্ত এলাকাতেও প্রতিটি পরিবারেই গরু, ছাগল, মুরগী পালন করা হচ্ছে। কিছু কিছু বাড়ীতে দেখলাম বিদেশী প্রজাতির শূকর পালিত হচ্ছে। সরকার থেকেই প্রতিটি বাড়ীতে রেড চিটাগাং জাতের গরু আর ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল দেয়া হয়েছে। গরুগুলোকে দল বেঁধে পাহাড়ে ছেড়ে দেয়া হয়। পাছে সন্ধ্যায় মালিকরা এদের হারিয়ে না ফেলে, সেজন্য একটি গরুর গলায় ঝোলানো থাকে শব্দ উৎপাদক কোন বস্তু। কেন এই ব্যবস্থা, তা জানতে চাইলে একজন বলল, একটি গরুর গলায় বাঁধা থাকলেই হবে। কারণ গরুরা ছাড়া অবস্থায় একে অপরের কাছ থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন থাকেনা।

বাঘাইহাট পেরিয়ে মাসালং নামের একটি স্থানে যাত্রাবিরতি করতে হয়। এর কাছ দিয়েই বয়ে গেছে কাসালং নদী। অত্যন্ত খরস্রোতা আর তামাটে বর্ণের পানি এই নদীর। মাসালং পার হলে যেন পাহাড়ের জীবনের অকৃত্রিমতা আরও স্পষ্টভাবে প্রতিভাতও হতে শুরু করে। নারীরা তো বটেই, অনেক পুরুষও ঐতিহ্যগত পোশাক লেংটি পরিধান করে থাকে। তবে যুগটা যে কলিকাল, তা বুঝা যায় তরুণদের পরনের থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, টিশার্ট দেখলে। অত্যন্ত সুন্দর এখানকার পরিবেশ। তেমন ঘন জঙ্গল নেই। মাঝেমাঝে ফলের বাগান, আর তার মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বহু বছরের পুরানো গাছ, যেগুলো দেখতে আফ্রিকার বাওয়াব গাছের মতো।

20161007_165911
সাজেকের ঢাল শুরুর কিছু আগে প্রকৃতির বিশালতার ভিড়ে এই ছোট্ট কুটিরের দৃশটি শিহরণ জাগানিয়া তো বটেই।

সাজেকের পর্যটন অঞ্চল শুরুর আগে প্রায় মাইল দেড়েকের একটি তীক্ষ্ণ ঢাল আছে। এই ঢাল বেয়ে উঠা কোন যেনতেন গাড়ীর কাজ নয়। সাজেক পর্যটন কেন্দ্রটি মূলত রুইলুই নামের একটি বসতি কেন্দ্রিক। টিকেট কেটে এলাকায় প্রবেশ করতে হয়। পুরো এলাকাটি মূলত পাহাড়ের চূড়া। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠলেই সেনাবাহিনীর সুরম্য সাজেক রিসোর্ট যেন অত্র অঞ্চলের নিগাহবানের মতো সবাইকে স্বাগত জানায়। বেশ ছিমছাম করে গড়ে তোলা হয়েছে এলাকাটিকে। রুইলুইয়ে একের পর এক পান্থশালা গড়ে উঠছে। তবে এখনও শানবাঁধানো রাস্তাঘাট খুবই পরিচ্ছন্ন। এখন পর্যন্ত মূলত সাজেক রিসোর্ট থেকে সেনাবাহিনীর ফাঁড়ী পর্যন্ত এলাকাটিকেই পর্যটনের জন্য উপযুক্ত করে তোলা হয়েছে। পরিকল্পিত আর ছিমছাম পরিবেশের মধ্যে যেন একটি দার্শনিক আভিজাত্য লুকিয়ে আছে। অবশ্য সাজেকে ভ্রমণ আর থাকা এখনও বেশ ব্যয়বহুল। তবে সাজেককে একটি আদর্শ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা সর্বক্ষেত্রেই দেখা গেছে।

20161008_075648
সাজেকের আইকনিক স্থাপনা- রুনময় রিসোর্ট। নিচে মেঘেরা খেলা করছে।
20161008_071834
সাজেক রিসোর্টের সামনের বাগিচা।
20161008_071337
সেনাবাহিনীর পরিচালিত সাজেক রিসোর্ট
20161008_090151
রুইলুই-সাজেক রাস্তার ধারে নির্মীয়মাণ একটি পান্থশালা। এখানে নির্মাণ উপকরণে কংক্রিটের চেয়ে কাঠ, বাঁশ আর টিনের প্রাধান্যই বেশি।

আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে, রুইলুইয়ে টুরিস্ট জোন করতে গিয়ে স্থানীয় বসতির ক্ষতি করা হয়নি। হোটেল আর রিসোর্টের ফাঁকে ফাঁকে তাই পাহাড়িদের বসতি দেখা যায়। কেউ কেউ আবার রাস্তার পাশেই পালন করছে গরু আর শূকর। তবে পুরো ব্যাপারটিতে কোনধরনের সমন্বয়হীনতা আর অপরিচ্ছন্নতার দেখা পাইনি। স্থানীয়রাও কোন বিধিনিষেধের বেড়াজালে নেই। এমনকি রাতবিরাতে দেশী মদ পান করে বেধড়ক মাতলামিতেও তাদের কেউ বাঁধা দেয়না।

20161008_074340
স্থানীয়দের এসব বাড়ীতে নাকি তুলনামূলক কম খরচে রাত্রিযাপনের সুযোগও মেলে
20161008_074557
সাজেকের পর্যটন কেন্দ্রে স্থানীয় পাহাড়িদের বাড়িঘর

তবে সাজেক ও তৎসংলগ্ন সমূদয় অঞ্চলের উন্নয়নে সেনাবাহিনীর ভূমিকার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। পাকিস্তানীরা যদি কারাকোরাম মহাসড়ককে অষ্টম আশ্চর্য হিসেবে অভিহিত করতে পারে, তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে উঁচু উঁচু পাহাড় ডিঙ্গিয়ে সেনা প্রকৌশলীদের নির্মিত এসব রাস্তাও অত্যাশ্চর্য হবার দাবী রাখে। সেনাবাহিনীর জন্য সাজেক নামের একটি গন্তব্যের খোঁজ পেয়েছে বাংলাদেশের ভ্রমণ পিপাসুরা। বলা বাহুল্য, সাজেকের রোশনাই আরও বাড়তেই থাকবে।

20161008_084211
সাজেক প্রকল্প এবং দুই হাজার মিটার উঁচু পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে ৩৪ কিলোমিটার রাস্তা টানার বিষয়ে সাজেকের সেনা ফাঁড়ীতে এই শিলালিপিটি দেখতে পেলাম। এর কাছেই ৩৪ কিলোমিটার পথ শেষ হয়েছে।

পর্যটন ছাড়াও সাজেকের অন্যান্য পূর্ত কর্মে সেনাবাহিনীর একচ্ছত্র ভূমিকা পরিলক্ষিত হল। এসব উন্নয়ন কাজের বেশিরভাগই চট্টগ্রামের ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি কতৃক উদ্বোধন হওয়া। খেয়াল করার মতো বিষয় হচ্ছে, যেখানে বাংলাদেশে কোন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর বা উদ্বোধনী ফলকে নিজের নাম বসাতে অনেকের মধ্যে হুড়োহুড়ি লেগে যায়, সেখানে সাজেকের উন্নয়ন কর্মের উদ্বোধনী ফলক দেখলাম নামবিহীন। এটা আমাকে অভিভূত করলো। আমি বিশ্বাস করলাম যে, সেনাবাহিনী আসলেই আন্তরিক উদ্দেশ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রামের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে।

20161008_090546
আমার দেখা প্রথম নামবিহীন ফলক ছিল এটা! সেসময় চট্টগ্রামের জিওসি ছিলেন সম্ভবত বর্তমানের আর্মি ট্রেনিং অ্যান্ড ডক্ট্রিন কমান্ডের জিওসি লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাব্বির আহমেদ। তাঁর নামটা আমার উল্লেখ করা উচিত বলেই আমি উল্লেখ করলাম!
20161008_074615
মেঘের ভেলার উপর ভাসমান রুইলুইয়ের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। সম্ভবত বাংলাদেশের উচ্চতম সরকারী স্কুলগুলোর একটি এটি!

শুধু সাজেকের কথাই বলছি না, বাঘাইহাট থেকে শুরু হওয়া রাস্তাটাও এর মধ্যে পড়ে। এই রাস্তা, এবং সাজেক পর্যটন কেন্দ্র পুরো অঞ্চলের আর্থসামাজিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটানো ইতোমধ্যেই শুরু করে দিয়েছে। যে অঞ্চল কয়েক বছর আগেও দারিদ্র পীড়িত ছিল, তা এখন টুরিস্ট জোন হিসেবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সোনালী দ্বার উন্মোচন করেছে। সাজেকের পর্যটন সম্ভাবনা এখনও নেহায়েত শিশু পর্যায়ে। আমি এর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি। বিশেষত সাজেক থেকে কংলাক পাড়া পর্যন্ত অঞ্চলটিকেও যদি কাঠামোবদ্ধ পর্যটন কেন্দ্রে রূপ দেয়া যায়, তবে এখানে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট হওয়াও অসম্ভব কিছু নয়। এখনই সাজেকের যাত্রীরা কংলাক ঘুরতে যায়। কংলাকে আছে রাঙ্গামাটি জেলার বৃহত্তম শৃঙ্গ সিপ্পি। সাজেক থেকে শুরু করে কংলাক পর্যন্ত এলাকাটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময়।

সাজেকে পর্যটনের বিকাশে কিছু চ্যালেঞ্জও আছে। এখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ এখনও স্বাভাবিক নয়। জেনারেটরের উপর নির্ভরশীল। সাজেকের প্রচুর বাতাস বয়। আমার মনে হয়, এখানে বিদ্যুতের স্থায়ী উৎস হিসেবে উইন্ড মিলের প্রবর্তন ঘটানো বেশ লাভজনক হবে। এই প্রসঙ্গে বিডিআরের সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ফজলুর রহমানের সাথে আলাপান্তে জানলাম, তিনিও নাকি আগেই অত্র অঞ্চকে উইন্ড মিলের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রস্তাবনা দিয়ে রেখেছিলেন। যেহেতু, সেনাবাহিনীতেও উইন্ড মিলের ধারণা বিরাজ করছে, সেহেতু ধারণা করা যায়, ভবিষ্যতে এখানে উইন্ড মিলের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে।

২৭০০ ফুট উচ্চতার সাজেকে বিশুদ্ধ পানির সংস্থান অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের কাজ। বর্তমানে বাঘাইহাট থেকে পিকআপে করে বিচ্ছিন্ন উদ্যোগে পানি আনা হয়। তবে এটা কোন স্থায়ী সংস্থান হতে পারেনা। অবশ্যই বিশুদ্ধ পানির জন্য স্থায়ী একটি পথ বের করতে হবে। আমার ধারণা বিদ্যুৎ ও পানির ক্ষেত্রে নিকটবর্তী ঝর্ণাগুলোকেও কাজে লাগানো যায়। ঝর্ণা হাইড্রো ইলেক্ট্রিসিটির পাশাপাশি সুপেয় পানিরও যোগান দিতে সক্ষম। বিদ্যুৎ ও পানির যোগান নিশ্চিত হলে সাজেকে থাকার খরচ বহুলাংশে কমে যাবে বলে ধারণা করি।

সাজেকের আরেকটি পরোক্ষ সমস্যা হচ্ছে চাঁদাবাজি। শুনেছি, উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা নাকি সাজেকের হোটেল মালিকদের কাছ থেকে মাসে ক্ষেত্রবিশেষে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা উসুল করে। এই তথ্যের সত্যমিথ্যা সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই, তবে সত্যি হয়ে থাকলে এর ফয়সালা হওয়া দরকার।

সবকিছু মিলিয়ে সাজককে আমার কাছে একটি দারুণ হিলষ্টেশন বলেই মনে হয়েছে। এমনকি গরমের অতিষ্ঠতা থেকে বাঁচতেও এখানে যাওয়া যায়। সাজেকে বিকাল থেকেই তাপমাত্রা কমে যেতে থাকে। গভীর রাতে রীতিমতো কনকনে শীত পড়ে যায়। এছাড়াও ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি সাজেকের আবহাওয়ায় যে অভিনবত্ব এনেছে, তা পর্যটক আকর্ষণে সহায়ক হতে পারে।

গত কয়েক বছরে হঠাৎ ভ্রমণ পিপাসুদের বাঁধা গন্তব্যে পরিণত হওয়া সাজেক যেন একটি কবিতা। সঠিক পরিকল্পনা, কর্মোদ্যোগ, আর বিদ্যমান সম্পদের সঠিক ব্যবহারের দ্বারা এই কবিতা মহাকাব্যে পরিণত হোক, এই কামনা …।

©সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সার্ক- বিলোপের সময় উদ্ভবের সময়ের রোমাঞ্চকর ইতিহাসের রোমন্থন, এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক আলাপ

এবছর ইসলামাবাদে অনুষ্ঠেয় সার্ক শীর্ষ সম্মেলন পণ্ড হয়ে যাবার প্রেক্ষিতে ত্রিশ বছরের পুরানো আঞ্চলিক জোট সার্ক নিয়ে আবার আলোচনা শুরু হয়েছে। সার্ক সম্মেলন পণ্ড করার প্রচেষ্টায় যেভাবে উপমহাদেশে একটি স্পষ্ট বিভক্তিরেখার সূত্রপাত দেখা গেলো, তা অচিরেই মুছে যাবে কিনা, তা নিয়ে এখন আলোচনা চলছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান তাঁর ব্যক্তিগত ফেসবুকে লিখেছেন সার্কের ভেঙ্গে যাবার সম্ভাবনার কথা। সার্কে ভেঙ্গে বা অবরুদ্ধ করে ভারত যে ভুটান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান বা শ্রীলংকার মতো দেশগুলোকে নিয়ে একটি পৃথক জোট গঠন করতে পারে, সে সম্ভাবনার কথাই তিনি তাঁর পোস্টে লিখেছেন। পত্রিকায় দেখলাম, ঢাকাস্থ সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী দিল্লীতে বাংলাদেশী সাংবাদিকদের সাথে আলাপচারিতায় সার্ক ভুলে বিমসটেক তথা বঙ্গোপসাগরীয় দেশগুলোর সমবায়ে গঠিত জোটের দিকে বাংলাদেশকে তাকাতে বলেছেন। আমি স্পষ্ট করেই বলতে চাই, ভারত হঠাৎ করেই সার্ক ভাঙ্গার চিন্তা করেনি। এটা দীর্ঘদিনের একটি পরিকল্পনার অংশ, যার নিরিখে আমরা বিমসটেক গঠিত হতে দেখেছি। মেকং-গঙ্গা কোঅপারেশন নামের জোট, এবং দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষত বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে উপ আঞ্চলিক সহযোগিতা, তথা বাংলাদেশকে কাজে লাগিয়ে কতিপয় ভারতীয় প্রদেশের অর্থনৈতিক ও ভূকৌশলগত সুবিধা বৃদ্ধির ধারণা দেখেছি।

সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে এটা আরও স্পষ্ট হয়েছে যে, অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা কেবল বাহানা বা উসিলা মাত্র, আজকালকার দিনে এহেন অর্থনৈতিক জোট বা আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণার মূলে প্রোথিত থাকে রাজনীতি ও বিশেষভাবে ভূরাজনৈতিক স্বার্থ।

সার্কের শুরুর কথা- একটি বাংলাদেশী স্বপ্নের আন্তর্জাতিকীকরণ

ঠিক কে, কবে দক্ষিণ একটি দক্ষিণ এশীয় জোটের বিষয়ে ভেবেছিলেন সেটা এখন আর বলা যায়না। তবে বাংলাদেশে এই বিষয়ে প্রথম যিনি ভেবেছিলেন, তিনি সম্ভবত আবুল মনসুর আহমদ। তাঁর কালজয়ী রাজনৈতিক আত্মজীবনী ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ এর সাক্ষী। এই বইয়ের একেবারে শেষের দিকে আবুল মনসুর ধারণা দিয়েছিলেন একটি ‘উপমহাদেশীয় ঐক্যজোট’ এর। তাঁর সেই রূপরেখায় উপমহাদেশীয় ঐক্যজোট গঠিত হতো উপমহাদেশের প্রধান তিনটি দেশ সমবায়ে। একজন প্রবীণ কংগ্রেসী ও ত্রিকালজ্ঞ রাজনীতিজ্ঞ হিসেবে উপমহাদেশীয় ঐক্যজোটের এই ধারণা আবুল মনসুর তাঁর সমগ্র জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই পেশ করেছিলেন বলে মনে হয়। তবে তিনি তাঁর প্রস্তাবিত উপমহাদেশীয় ঐক্যজোটের মডেল হিসেবে সামনে এনেছিলেন ইউরোপীয় সংঘের পূর্বসূরি ইউরোপিয়ান ইকোনোমিক কমিউনিটি বা ই ই সিকে। আবুল মনসুর পরবর্তীতে এই উপমহাদেশীয় ঐক্যজোটে শ্রীলংকা, ব্রহ্মদেশ, সিকিম (তখনও অধিকৃত হয়নি), নেপাল, ভুটান ও আফগানিস্তানকে অন্তর্ভুক্তির কথা লিখেছিলেন। আবুল মনসুর আহমদের কল্পিত সেই উপমহাদেশীয় সংঘ ক্রমান্বয়ে সম্পূর্ণ মুক্ত বাজার অঞ্চল হবে, এবং প্রতিবেশীদের আস্থা অর্জন করলে তার স্বাভাবিক নেতৃত্ব ভারতই দেবে, এমন কথাই লেখা আছে।

কিন্তু পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান দক্ষিণ এশীয় ঐক্যের এই ধারণাকে বাস্তবসম্মত ও উপমহাদেশের ছোট ছোট দেশগুলোর জন্য সুবিধাজনক আকারে পেশ করে একটি রূপকল্প খাড়া করেছিলেন, যার ধারাবাহিকতায় ১৯৮৫ সালে ঢাকায় জাতীয় সংসদ ভবনে প্রতিষ্ঠিত হয় সার্ক। সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে প্রেসিডেন্ট জিয়া কতোটা আবুল মনসুর আহমদের বলে যাওয়া উপমহাদেশীয় ঐক্যের ধারণা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন তা এখন আর পরিমাপ করা সম্ভব না। যুবদলের প্রতিষ্ঠাতা কমিটির অন্যতম সদস্য আহমদ মীর্জা খবীর এক বইয়ে লিখেছেন, জিয়াউর রহমান তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের বিনির্মাণে যাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে আবুল মনসুর আহমদও ছিলেন।

তবে এটা ঠিক যে, আবুল মনসুর আহমদের উপমহাদেশীয় ঐক্যের ধারণা ও জিয়ার উপমহাদেশীয় ঐক্যের ধারণার মধ্যে বুনিয়াদী পার্থক্য আছে। আবুল মনসুর প্রস্তাবিত উপমহাদেশীয় ঐক্যে প্রতিবেশীদের আস্থা অর্জন সাপেক্ষে ভারতের নেতৃত্ব স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে রাজী ছিলেন। কিন্তু আমার ধারণা, দক্ষিণ এশীয় জোট গঠনের কথা চিন্তার সময় জিয়া একজন কৌশলী জেনারেলের মতোই ভেবেছিলেন। বাস্তবতার নিরিখে এধরণের জোটে ভারতের নেতৃত্বের সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য সম্পর্কে তিনি সাবধান ছিলেন বলেই তিনি এমনভাবে ঘটনাপ্রবাহ গড়িয়ে দেন, যার কারণে প্রতিষ্ঠার সময় সার্ক নেতারা কোন দ্বিপাক্ষিক সমস্যা ফোরামে না তোলা, এবং সকল সদস্যের সম্মতির পর কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের বাদ্ধবাধকতা আরোপে বাধ্য হন। এই দুটি বিধান মূলত সার্কে কোন বিশেষ দেশের মনপলি রুখবার জন্যই সামনে আনা হয়েছিলো।

কোন বিশেষ দেশের মনপলি বা বাঁধার বিষয়ে জিয়াউর রহমান কতোটা সাবধানী ছিলেন, তার প্রমাণ মেলে ১৯৭৯ সালে সার্ক গঠনের প্রস্তাব প্রথম দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর কাছে পাঠানোর সময় গৃহীত পদক্ষেপগুলো থেকে। কয়েক বছর আগে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও বর্তমানে দিল্লীতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী, এবং সার্কের সাবেক মহাসচিব কিউ এম এ রহিম সার্ক গঠনের শুরুর সেই সময়ের অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক বর্ণনা দিয়েছিলেন।

এই দুই বর্ষীয়ান পেশাদার কূটনীতিকের থেকে যা জেনেছিলাম তা হচ্ছে, ১৯৭৯ সালে হাভানায় আয়োজিত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের ষষ্ঠ সম্মেলন থেকেই এসেই জিয়াউর রহমান দক্ষিণ এশিয়া কেন্দ্রিক একটি জোট গঠনের জন্য সক্রিয় হন। সেসময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন শামস উল হক ও সচিব ছিলেন পরবর্তীতে হাসিনা ওয়াজেদের প্রথম সরকারের অর্থমন্ত্রী শাহ আবু মোহাম্মদ শামসুল কিবরিয়া। জিয়াউর রহমান সার্ক গঠনে তিনটি দেশের সম্ভাব্য বিরোধিতার কথা মাথায় রেখেছিলেন। দেশগুলো হচ্ছে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকা। ভারত ও পাকিস্তানের সম্ভাব্য বিরোধিতার কারণ ছিল অভিন্ন। এই দুটি দেশই দক্ষিণ এশিয়া জোট গঠনের বাংলাদেশী জোটকে অপর পক্ষের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখতে পারে। পাকিস্তান ভাবতে পারে, বাংলাদেশ ভারতের কথায় এই জোট গঠনে উদ্যোগ নিয়েছে, যার আসল উদ্দেশ্য পাকিস্তানকে কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করা। তেমনিভাবে ভারতও পুরো বিষয়টিকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মিলিত আঁতাত হিসেবে ভারতকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরার পরিকল্পনা হিসেবে দেখবে বলে প্রেসিডেন্ট নিশ্চিত ছিলেন। এই বিষয়ে তিনি শামস উল হক ও শাহ কিবরিয়ার সাথে আলোচনাও করেছিলেন।

যাহোক, বিদ্যমান পরিস্থিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে উপায়ে সার্ক গঠনের প্রস্তাবনা বাকি দেশগুলোর কাছে পাঠায় তা এসপিওনাজ গপ্পের মতো অবাক করা। প্রথমেই মালদ্বীপ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচ দেশ নেপাল,  ভুটান, শ্রীলংকা, পাকিস্তান ও ভারতে পাঁচজন মন্ত্রীকে প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত হিসেবে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। এদের কাছে সংশ্লিষ্ট দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের প্রতি সার্ক গঠনের প্রস্তাবনা সংক্রান্ত বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের একটি করে চিঠি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পাছে দক্ষিণ এশীয় জোটের প্রস্তাবনা দিল্লী ও ইসলামাবাদ আগেই আঁচ পেয়ে যায়, এই আশংকায় দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে ব্রহ্মদেশ ও ইরাকেও অনুরূপ দুইজন  মন্ত্রীকে প্রেসিডেন্ট জিয়ার চিঠি সহকারে পাঠানো হয়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অত্যন্ত সুচারুরূপে পাঁচ দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের বৈঠকের সময়সূচী এভাবে নির্ধারণ করে, যাতে প্রত্যেকে একই সময়ে এই চিঠিগুলো অবমুক্ত করতে পারেন। একই সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঁচজন কর্মকর্তাকে ঢাকাস্থ পাকিস্তান, নেপাল, ভারত ও শ্রীলংকার দূতাবাসের আশেপাশের এলাকায় সার্কের প্রস্তাবনার লিখিত রূপ সম্বলিত নথি নিয়ে হাজির থাকতে বলা হয়। পররাষ্ট্র সচিব কিবরিয়া একই সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি সাংবাদিক সম্মেলনের ডাক দেন, যেখানে সার্ক গঠনে বাংলাদেশের প্রস্তাবনা প্রকাশ করার ফয়সালা হয়।

এই তিনটি কাজ, তথা মন্ত্রীদের একই সময়ে বিদেশী রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সামনে গিয়ে চিঠি দেয়া, দূতাবাসে প্রস্তাবনার লিখিত নথি প্রদানের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঁচ কর্মকর্তাকে দূতাবাসসমূহের আশেপাশে রাখার পেছনে প্রধান কারণ ছিল উপরিউল্লেখিত পাঁচটি দেশকে চমৎকৃত করে বিমুঢ় করে দেয়া, যাতে তারা তড়িৎ গতিতে প্রস্তাবটি খারিজ করার সুযোগ না পায়।

অপরদিকে, একই সময়ে ঢাকায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিবের সাংবাদিক সম্মেলন ডাকার কারণ ছিল, উপরিউল্লেখিত চমক কেটে যাবার পর মুহূর্তে যেন ভারত বা পাকিস্তান নিজ নিজ উদ্যোগে সাংবাদিকদের কাছে বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ এশীয় জোট গঠনের কোন প্রস্তাব পাবার কথা অস্বীকার করে পুরো বিষয়টিতে ধোঁয়াশা ও অনিশ্চয়তার জন্ম না দিতে পারে, তা নিশ্চিত করা। বলা বাহুল্য, প্রতিটি কাজই সেবার সুচারু রূপে সম্পন্ন হয়।

সেবার বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের চিঠি নিয়ে শ্রীলংকা গেছিলেন তৎকালীন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী ও পরবর্তীতে অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান। তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে ছিলেন কিউ এম এ রহিম, যিনি তখন সম্ভবত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোন অণুবিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর জবানীতে শুনেছি, সাইফুর রহমান যখন জিয়াউর রহমানের সীলমোহর করা চিঠি শ্রীলংকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুনিয়াস জয়বর্ধনের হাতে দেন, তখন প্রেসিডেন্টের মুখে স্বাভাবিক কূটনৈতিক স্মিতহাসি ছিল। কিন্তু যেই তাঁকে চিঠির বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানানো হয়, তখন নাকি তাঁর মুখ মাছের মতো হয়ে গেছিলো!

এভাবেই কূটনীতিতে সামরিক কৌশলের অসামান্য প্রয়োগের দ্বারা বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার কলহপ্রিয় দেশগুলোকে এক ছাদের তলে সমবেত করার সফল উদ্যোগ গ্রহণ করে। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি গৌরবজনক ঘটনা ছিল সেটি।

জিয়াউর রহমান যতদিন বেঁচে ছিলেন, সার্ক নিয়ে বাংলাদেশ অতি স্থিতধী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যেমন প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ডাক ব্যবস্থার আধুনিকায়ক নিয়ে কাজ করার আহবান জানায়। এরপর আসে পর্যটনের বিষয়। এভাবে ১৯৮৫ সালে সার্ক গঠিত হয়ে যায়। জিয়াউর রহমানের পরিকল্পনায় সার্কে আফগানিস্তান বা মালদ্বীপকে রাখা হয়নি, ব্রহ্মদেশকে রাখা হয়েছিলো। ১৯৮৫ সাল নাগাদ নে উইনের পাগলাটে সরকার সার্ক গঠন প্রক্রিয়া থেকে ছিটকে পড়ে। তার বদলে মালদ্বীপকে নেয়া হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আবুল মনসুর আহমদের উপমহাদেশীয় ঐক্যজোটের রূপরেখায়ও মালদ্বীপ ছিলোনা। তবে আফগানিস্তান  ছিল।

বর্তমান প্রেক্ষিতে বিমসটেক, মেকং-গঙ্গা কোঅপারেশন, বা উপ আঞ্চলিক জোটের ধারণা

এই বিষয়গুলো এখন বহুল চর্চিত। এগুলো ছাড়াও বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও ব্রহ্মদেশকে নিয়ে বিসিআইএম ইকোনোমিক করিডোর নামে আরেকটি উপ আঞ্চলিক জোটের ধারণা গজিয়েছে। আমার সন্দেহ হয়, এসব ধারণার পেছনে অর্থনৈতিক সদিচ্ছার চেয়ে ভূরাজনৈতিক স্বার্থের বিষয়টিই বেশি জড়িত। বিমসটেককে খালি চোখে দেখলেই মনে হয়, অর্থনৈতিক জোটের আড়ালে এই জোট বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে ইন্দো-মার্কিন প্রভাব বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। একইভাবে ভারত, শ্যামদেশ, কম্বোডিয়া, লাওস ও ভিয়েতনাম সমবায়ে আহুত মেকং-গঙ্গা কোঅপারেশনের ধারণার ক্ষেত্রেও দেখা যায়। মেকং নদী ভিয়েতনামের দক্ষিণাংশ ও কম্বোডিয়া দিয়ে দক্ষিণ চীন সাগরে পতিত হয়েছে। সম্প্রতি চীনকে একঘরে করতে আমেরিকার সাহায্যে ভারত ভিয়েতনামে নৌঘাঁটি নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। মেকং-গঙ্গা কোঅপারেশন এক্ষেত্রে বঙ্গোপসাগর থেকে শুরু করে ভিয়েতনাম পর্যন্ত অঞ্চলে চীনের প্রভাব খর্ব করে ইন্দো-মার্কিন প্রভাব বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে। আর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার উপ আঞ্চলিক জোট গঠনের তাৎপর্য বোধহয় আর খোলাসা করতে হবেনা, কারণ বাংলাদেশীদের কাছে ট্রানজিট নামের শব্দটি বহুল পরিচিত। এই জোটে নেপাল ও ভুটানের অন্তর্ভুক্তি স্রেফ অলংকারই হতে পারে।

বিদ্যমান প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের করনীয়

বিগত কয়েক বছরে চীনের বিস্ময়কর উত্থান ও সিনো-রুশ মৈত্রীর নতুন পর্যায় উপনীত হওয়ায় এশিয়ার আন্তর্জাতিক পরিস্থিতে যেমন বিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাতে একটি সার্কের ভবিষ্যৎ তমসাচ্ছন্ন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। তবে তমসাচ্ছন্ন সার্ক মানে তমসাচ্ছন্ন দক্ষিণ এশীয় ঐক্যের ধারণা নয়। সার্কের মৃত্যু হলেও ভিন্ন আঙ্গিকে দক্ষিণ এশীয় ঐক্যের ধারণা থেকেই যাবে, যার থেকে হয়তো কোন সময় জন্ম নেবে দক্ষিণ এশিয়া কমনওয়েলথ, বা দক্ষিণ এশীয় সংঘের মতো কোন জোটের। তার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশকে আঞ্চলিক সহযোগিতা বাস্তবভিত্তিক পথে হাঁটতে হবে, যার জন্য আসিয়ানে যোগ দেয়া ছাড়া বাংলাদেশের সামনে আর কোন রাস্তা খোলা নেই।

উপরে আমি যে সম্ভাব্য দক্ষিণ এশিয়ান কমনওয়েলথ বা সংঘের কথা লিখেছি, সেই ধারণার উদ্গাতাও বাংলাদেশ হতে পারে। তবে তার জন্য বাংলাদেশকে যথাবিহিত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। একটি বাস্তবভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতি এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাথেয় হতে পারে। ফলে লক্ষ্য অর্জনে সঠিক রাস্তা ধরা বাংলাদেশের জন্য এখন অতীব জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে…।

©সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত