এবছর ইসলামাবাদে অনুষ্ঠেয় সার্ক শীর্ষ সম্মেলন পণ্ড হয়ে যাবার প্রেক্ষিতে ত্রিশ বছরের পুরানো আঞ্চলিক জোট সার্ক নিয়ে আবার আলোচনা শুরু হয়েছে। সার্ক সম্মেলন পণ্ড করার প্রচেষ্টায় যেভাবে উপমহাদেশে একটি স্পষ্ট বিভক্তিরেখার সূত্রপাত দেখা গেলো, তা অচিরেই মুছে যাবে কিনা, তা নিয়ে এখন আলোচনা চলছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান তাঁর ব্যক্তিগত ফেসবুকে লিখেছেন সার্কের ভেঙ্গে যাবার সম্ভাবনার কথা। সার্কে ভেঙ্গে বা অবরুদ্ধ করে ভারত যে ভুটান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান বা শ্রীলংকার মতো দেশগুলোকে নিয়ে একটি পৃথক জোট গঠন করতে পারে, সে সম্ভাবনার কথাই তিনি তাঁর পোস্টে লিখেছেন। পত্রিকায় দেখলাম, ঢাকাস্থ সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী দিল্লীতে বাংলাদেশী সাংবাদিকদের সাথে আলাপচারিতায় সার্ক ভুলে বিমসটেক তথা বঙ্গোপসাগরীয় দেশগুলোর সমবায়ে গঠিত জোটের দিকে বাংলাদেশকে তাকাতে বলেছেন। আমি স্পষ্ট করেই বলতে চাই, ভারত হঠাৎ করেই সার্ক ভাঙ্গার চিন্তা করেনি। এটা দীর্ঘদিনের একটি পরিকল্পনার অংশ, যার নিরিখে আমরা বিমসটেক গঠিত হতে দেখেছি। মেকং-গঙ্গা কোঅপারেশন নামের জোট, এবং দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষত বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে উপ আঞ্চলিক সহযোগিতা, তথা বাংলাদেশকে কাজে লাগিয়ে কতিপয় ভারতীয় প্রদেশের অর্থনৈতিক ও ভূকৌশলগত সুবিধা বৃদ্ধির ধারণা দেখেছি।
সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে এটা আরও স্পষ্ট হয়েছে যে, অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা কেবল বাহানা বা উসিলা মাত্র, আজকালকার দিনে এহেন অর্থনৈতিক জোট বা আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণার মূলে প্রোথিত থাকে রাজনীতি ও বিশেষভাবে ভূরাজনৈতিক স্বার্থ।
সার্কের শুরুর কথা- একটি বাংলাদেশী স্বপ্নের আন্তর্জাতিকীকরণ
ঠিক কে, কবে দক্ষিণ একটি দক্ষিণ এশীয় জোটের বিষয়ে ভেবেছিলেন সেটা এখন আর বলা যায়না। তবে বাংলাদেশে এই বিষয়ে প্রথম যিনি ভেবেছিলেন, তিনি সম্ভবত আবুল মনসুর আহমদ। তাঁর কালজয়ী রাজনৈতিক আত্মজীবনী ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ এর সাক্ষী। এই বইয়ের একেবারে শেষের দিকে আবুল মনসুর ধারণা দিয়েছিলেন একটি ‘উপমহাদেশীয় ঐক্যজোট’ এর। তাঁর সেই রূপরেখায় উপমহাদেশীয় ঐক্যজোট গঠিত হতো উপমহাদেশের প্রধান তিনটি দেশ সমবায়ে। একজন প্রবীণ কংগ্রেসী ও ত্রিকালজ্ঞ রাজনীতিজ্ঞ হিসেবে উপমহাদেশীয় ঐক্যজোটের এই ধারণা আবুল মনসুর তাঁর সমগ্র জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই পেশ করেছিলেন বলে মনে হয়। তবে তিনি তাঁর প্রস্তাবিত উপমহাদেশীয় ঐক্যজোটের মডেল হিসেবে সামনে এনেছিলেন ইউরোপীয় সংঘের পূর্বসূরি ইউরোপিয়ান ইকোনোমিক কমিউনিটি বা ই ই সিকে। আবুল মনসুর পরবর্তীতে এই উপমহাদেশীয় ঐক্যজোটে শ্রীলংকা, ব্রহ্মদেশ, সিকিম (তখনও অধিকৃত হয়নি), নেপাল, ভুটান ও আফগানিস্তানকে অন্তর্ভুক্তির কথা লিখেছিলেন। আবুল মনসুর আহমদের কল্পিত সেই উপমহাদেশীয় সংঘ ক্রমান্বয়ে সম্পূর্ণ মুক্ত বাজার অঞ্চল হবে, এবং প্রতিবেশীদের আস্থা অর্জন করলে তার স্বাভাবিক নেতৃত্ব ভারতই দেবে, এমন কথাই লেখা আছে।
কিন্তু পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান দক্ষিণ এশীয় ঐক্যের এই ধারণাকে বাস্তবসম্মত ও উপমহাদেশের ছোট ছোট দেশগুলোর জন্য সুবিধাজনক আকারে পেশ করে একটি রূপকল্প খাড়া করেছিলেন, যার ধারাবাহিকতায় ১৯৮৫ সালে ঢাকায় জাতীয় সংসদ ভবনে প্রতিষ্ঠিত হয় সার্ক। সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে প্রেসিডেন্ট জিয়া কতোটা আবুল মনসুর আহমদের বলে যাওয়া উপমহাদেশীয় ঐক্যের ধারণা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন তা এখন আর পরিমাপ করা সম্ভব না। যুবদলের প্রতিষ্ঠাতা কমিটির অন্যতম সদস্য আহমদ মীর্জা খবীর এক বইয়ে লিখেছেন, জিয়াউর রহমান তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের বিনির্মাণে যাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে আবুল মনসুর আহমদও ছিলেন।
তবে এটা ঠিক যে, আবুল মনসুর আহমদের উপমহাদেশীয় ঐক্যের ধারণা ও জিয়ার উপমহাদেশীয় ঐক্যের ধারণার মধ্যে বুনিয়াদী পার্থক্য আছে। আবুল মনসুর প্রস্তাবিত উপমহাদেশীয় ঐক্যে প্রতিবেশীদের আস্থা অর্জন সাপেক্ষে ভারতের নেতৃত্ব স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে রাজী ছিলেন। কিন্তু আমার ধারণা, দক্ষিণ এশীয় জোট গঠনের কথা চিন্তার সময় জিয়া একজন কৌশলী জেনারেলের মতোই ভেবেছিলেন। বাস্তবতার নিরিখে এধরণের জোটে ভারতের নেতৃত্বের সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য সম্পর্কে তিনি সাবধান ছিলেন বলেই তিনি এমনভাবে ঘটনাপ্রবাহ গড়িয়ে দেন, যার কারণে প্রতিষ্ঠার সময় সার্ক নেতারা কোন দ্বিপাক্ষিক সমস্যা ফোরামে না তোলা, এবং সকল সদস্যের সম্মতির পর কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের বাদ্ধবাধকতা আরোপে বাধ্য হন। এই দুটি বিধান মূলত সার্কে কোন বিশেষ দেশের মনপলি রুখবার জন্যই সামনে আনা হয়েছিলো।
কোন বিশেষ দেশের মনপলি বা বাঁধার বিষয়ে জিয়াউর রহমান কতোটা সাবধানী ছিলেন, তার প্রমাণ মেলে ১৯৭৯ সালে সার্ক গঠনের প্রস্তাব প্রথম দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর কাছে পাঠানোর সময় গৃহীত পদক্ষেপগুলো থেকে। কয়েক বছর আগে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও বর্তমানে দিল্লীতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী, এবং সার্কের সাবেক মহাসচিব কিউ এম এ রহিম সার্ক গঠনের শুরুর সেই সময়ের অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক বর্ণনা দিয়েছিলেন।
এই দুই বর্ষীয়ান পেশাদার কূটনীতিকের থেকে যা জেনেছিলাম তা হচ্ছে, ১৯৭৯ সালে হাভানায় আয়োজিত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের ষষ্ঠ সম্মেলন থেকেই এসেই জিয়াউর রহমান দক্ষিণ এশিয়া কেন্দ্রিক একটি জোট গঠনের জন্য সক্রিয় হন। সেসময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন শামস উল হক ও সচিব ছিলেন পরবর্তীতে হাসিনা ওয়াজেদের প্রথম সরকারের অর্থমন্ত্রী শাহ আবু মোহাম্মদ শামসুল কিবরিয়া। জিয়াউর রহমান সার্ক গঠনে তিনটি দেশের সম্ভাব্য বিরোধিতার কথা মাথায় রেখেছিলেন। দেশগুলো হচ্ছে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকা। ভারত ও পাকিস্তানের সম্ভাব্য বিরোধিতার কারণ ছিল অভিন্ন। এই দুটি দেশই দক্ষিণ এশিয়া জোট গঠনের বাংলাদেশী জোটকে অপর পক্ষের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখতে পারে। পাকিস্তান ভাবতে পারে, বাংলাদেশ ভারতের কথায় এই জোট গঠনে উদ্যোগ নিয়েছে, যার আসল উদ্দেশ্য পাকিস্তানকে কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করা। তেমনিভাবে ভারতও পুরো বিষয়টিকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মিলিত আঁতাত হিসেবে ভারতকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরার পরিকল্পনা হিসেবে দেখবে বলে প্রেসিডেন্ট নিশ্চিত ছিলেন। এই বিষয়ে তিনি শামস উল হক ও শাহ কিবরিয়ার সাথে আলোচনাও করেছিলেন।
যাহোক, বিদ্যমান পরিস্থিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে উপায়ে সার্ক গঠনের প্রস্তাবনা বাকি দেশগুলোর কাছে পাঠায় তা এসপিওনাজ গপ্পের মতো অবাক করা। প্রথমেই মালদ্বীপ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচ দেশ নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা, পাকিস্তান ও ভারতে পাঁচজন মন্ত্রীকে প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত হিসেবে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। এদের কাছে সংশ্লিষ্ট দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের প্রতি সার্ক গঠনের প্রস্তাবনা সংক্রান্ত বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের একটি করে চিঠি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পাছে দক্ষিণ এশীয় জোটের প্রস্তাবনা দিল্লী ও ইসলামাবাদ আগেই আঁচ পেয়ে যায়, এই আশংকায় দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে ব্রহ্মদেশ ও ইরাকেও অনুরূপ দুইজন মন্ত্রীকে প্রেসিডেন্ট জিয়ার চিঠি সহকারে পাঠানো হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অত্যন্ত সুচারুরূপে পাঁচ দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের বৈঠকের সময়সূচী এভাবে নির্ধারণ করে, যাতে প্রত্যেকে একই সময়ে এই চিঠিগুলো অবমুক্ত করতে পারেন। একই সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঁচজন কর্মকর্তাকে ঢাকাস্থ পাকিস্তান, নেপাল, ভারত ও শ্রীলংকার দূতাবাসের আশেপাশের এলাকায় সার্কের প্রস্তাবনার লিখিত রূপ সম্বলিত নথি নিয়ে হাজির থাকতে বলা হয়। পররাষ্ট্র সচিব কিবরিয়া একই সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি সাংবাদিক সম্মেলনের ডাক দেন, যেখানে সার্ক গঠনে বাংলাদেশের প্রস্তাবনা প্রকাশ করার ফয়সালা হয়।
এই তিনটি কাজ, তথা মন্ত্রীদের একই সময়ে বিদেশী রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সামনে গিয়ে চিঠি দেয়া, দূতাবাসে প্রস্তাবনার লিখিত নথি প্রদানের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঁচ কর্মকর্তাকে দূতাবাসসমূহের আশেপাশে রাখার পেছনে প্রধান কারণ ছিল উপরিউল্লেখিত পাঁচটি দেশকে চমৎকৃত করে বিমুঢ় করে দেয়া, যাতে তারা তড়িৎ গতিতে প্রস্তাবটি খারিজ করার সুযোগ না পায়।
অপরদিকে, একই সময়ে ঢাকায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিবের সাংবাদিক সম্মেলন ডাকার কারণ ছিল, উপরিউল্লেখিত চমক কেটে যাবার পর মুহূর্তে যেন ভারত বা পাকিস্তান নিজ নিজ উদ্যোগে সাংবাদিকদের কাছে বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ এশীয় জোট গঠনের কোন প্রস্তাব পাবার কথা অস্বীকার করে পুরো বিষয়টিতে ধোঁয়াশা ও অনিশ্চয়তার জন্ম না দিতে পারে, তা নিশ্চিত করা। বলা বাহুল্য, প্রতিটি কাজই সেবার সুচারু রূপে সম্পন্ন হয়।
সেবার বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের চিঠি নিয়ে শ্রীলংকা গেছিলেন তৎকালীন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী ও পরবর্তীতে অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান। তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে ছিলেন কিউ এম এ রহিম, যিনি তখন সম্ভবত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোন অণুবিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর জবানীতে শুনেছি, সাইফুর রহমান যখন জিয়াউর রহমানের সীলমোহর করা চিঠি শ্রীলংকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুনিয়াস জয়বর্ধনের হাতে দেন, তখন প্রেসিডেন্টের মুখে স্বাভাবিক কূটনৈতিক স্মিতহাসি ছিল। কিন্তু যেই তাঁকে চিঠির বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানানো হয়, তখন নাকি তাঁর মুখ মাছের মতো হয়ে গেছিলো!
এভাবেই কূটনীতিতে সামরিক কৌশলের অসামান্য প্রয়োগের দ্বারা বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার কলহপ্রিয় দেশগুলোকে এক ছাদের তলে সমবেত করার সফল উদ্যোগ গ্রহণ করে। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি গৌরবজনক ঘটনা ছিল সেটি।
জিয়াউর রহমান যতদিন বেঁচে ছিলেন, সার্ক নিয়ে বাংলাদেশ অতি স্থিতধী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যেমন প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ডাক ব্যবস্থার আধুনিকায়ক নিয়ে কাজ করার আহবান জানায়। এরপর আসে পর্যটনের বিষয়। এভাবে ১৯৮৫ সালে সার্ক গঠিত হয়ে যায়। জিয়াউর রহমানের পরিকল্পনায় সার্কে আফগানিস্তান বা মালদ্বীপকে রাখা হয়নি, ব্রহ্মদেশকে রাখা হয়েছিলো। ১৯৮৫ সাল নাগাদ নে উইনের পাগলাটে সরকার সার্ক গঠন প্রক্রিয়া থেকে ছিটকে পড়ে। তার বদলে মালদ্বীপকে নেয়া হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আবুল মনসুর আহমদের উপমহাদেশীয় ঐক্যজোটের রূপরেখায়ও মালদ্বীপ ছিলোনা। তবে আফগানিস্তান ছিল।
বর্তমান প্রেক্ষিতে বিমসটেক, মেকং-গঙ্গা কোঅপারেশন, বা উপ আঞ্চলিক জোটের ধারণা
এই বিষয়গুলো এখন বহুল চর্চিত। এগুলো ছাড়াও বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও ব্রহ্মদেশকে নিয়ে বিসিআইএম ইকোনোমিক করিডোর নামে আরেকটি উপ আঞ্চলিক জোটের ধারণা গজিয়েছে। আমার সন্দেহ হয়, এসব ধারণার পেছনে অর্থনৈতিক সদিচ্ছার চেয়ে ভূরাজনৈতিক স্বার্থের বিষয়টিই বেশি জড়িত। বিমসটেককে খালি চোখে দেখলেই মনে হয়, অর্থনৈতিক জোটের আড়ালে এই জোট বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে ইন্দো-মার্কিন প্রভাব বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। একইভাবে ভারত, শ্যামদেশ, কম্বোডিয়া, লাওস ও ভিয়েতনাম সমবায়ে আহুত মেকং-গঙ্গা কোঅপারেশনের ধারণার ক্ষেত্রেও দেখা যায়। মেকং নদী ভিয়েতনামের দক্ষিণাংশ ও কম্বোডিয়া দিয়ে দক্ষিণ চীন সাগরে পতিত হয়েছে। সম্প্রতি চীনকে একঘরে করতে আমেরিকার সাহায্যে ভারত ভিয়েতনামে নৌঘাঁটি নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। মেকং-গঙ্গা কোঅপারেশন এক্ষেত্রে বঙ্গোপসাগর থেকে শুরু করে ভিয়েতনাম পর্যন্ত অঞ্চলে চীনের প্রভাব খর্ব করে ইন্দো-মার্কিন প্রভাব বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে। আর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার উপ আঞ্চলিক জোট গঠনের তাৎপর্য বোধহয় আর খোলাসা করতে হবেনা, কারণ বাংলাদেশীদের কাছে ট্রানজিট নামের শব্দটি বহুল পরিচিত। এই জোটে নেপাল ও ভুটানের অন্তর্ভুক্তি স্রেফ অলংকারই হতে পারে।
বিদ্যমান প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের করনীয়
বিগত কয়েক বছরে চীনের বিস্ময়কর উত্থান ও সিনো-রুশ মৈত্রীর নতুন পর্যায় উপনীত হওয়ায় এশিয়ার আন্তর্জাতিক পরিস্থিতে যেমন বিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাতে একটি সার্কের ভবিষ্যৎ তমসাচ্ছন্ন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। তবে তমসাচ্ছন্ন সার্ক মানে তমসাচ্ছন্ন দক্ষিণ এশীয় ঐক্যের ধারণা নয়। সার্কের মৃত্যু হলেও ভিন্ন আঙ্গিকে দক্ষিণ এশীয় ঐক্যের ধারণা থেকেই যাবে, যার থেকে হয়তো কোন সময় জন্ম নেবে দক্ষিণ এশিয়া কমনওয়েলথ, বা দক্ষিণ এশীয় সংঘের মতো কোন জোটের। তার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশকে আঞ্চলিক সহযোগিতা বাস্তবভিত্তিক পথে হাঁটতে হবে, যার জন্য আসিয়ানে যোগ দেয়া ছাড়া বাংলাদেশের সামনে আর কোন রাস্তা খোলা নেই।
উপরে আমি যে সম্ভাব্য দক্ষিণ এশিয়ান কমনওয়েলথ বা সংঘের কথা লিখেছি, সেই ধারণার উদ্গাতাও বাংলাদেশ হতে পারে। তবে তার জন্য বাংলাদেশকে যথাবিহিত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। একটি বাস্তবভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতি এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাথেয় হতে পারে। ফলে লক্ষ্য অর্জনে সঠিক রাস্তা ধরা বাংলাদেশের জন্য এখন অতীব জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে…।
©সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত